স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ১০ এপ্রিল : বাংলাদেশে দাপিয়ে বেরাচ্ছে মৌলবাদীরা। প্রতিনিয়ত নির্যাতন, নিপীড়নের শিকার হিন্দুরা। হামলা হচ্ছে একের পর এক হিন্দু মন্দিরে। দুর্গাপুজোর সময় পুজো কমিটিগুলো নানাভাবে হুমকি দেওয়া হয়েছিল। সরস্বতী পুজোর ব্যানারের উপর লাগিয়ে দেওয়া হয় ইসলামি শিবিরের পোস্টার। এহেন ঘটনার পর এখন চর্চায় আসন্ন পয়লা বৈশাখ। ইতিমধ্যেই ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম নিয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়েছে ইসলামি আন্দোলনের মতো একাধিক মৌলবাদী সংগঠন। মঙ্গল শোভাযাত্রা কোনওভাবেই করা যাবে না বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে বিবৃতি দিয়েছে তারা। এমনকী নববর্ষের উদযাপনে ইসলাম সমর্থিত ধারণাকে তুলে ধরার কথা বলা হয়েছে। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশে বৈশাখী উদযাপনের নাম পরিবর্তন নিয়েও ভাবনা শুরু হয়েছে। ফলে পয়লা বৈশাখ কতটা সুষ্ঠুভাবে পালিত হবে ‘নতুন’ বাংলাদেশে তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় তৈরি হয়েছে।
বাংলাদেশে পয়লা বৈশাখ উদযাপন কখনই ভালো চোখে দেখেনি মৌলবাদী দলগুলো। দেড় দশক আগে ঢাকার রমনা বটমূলে পয়লা বৈশাখ উৎসবে বোমা হামলা হয়। তাতে বহু মানুষ প্রাণ হারান। তাই হাসিনা সরকারের পতনের পর পয়লা বৈশাখ নিয়ে আরও বেশি সংশয় তৈরি হয়েছে। তবে এবছর সুন্দরভাবে পয়লা বৈশাখ উৎসব উদযাপন নিয়ে নানা পরিকল্পনা করা হয়েছে। কয়েকদিন আগেই শিক্ষা ও প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে বিবৃতি জারি করে নির্দেশ দেয় যে, দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের নিয়ে শোভাযাত্রা করতে হবে।
কিন্তু এর মাঝেই এবার ইসলামি আন্দোলনের পক্ষ থেকে পয়লা বৈশাখ নিয়ে রীতিমত ‘ফতোয়া’ জারি করে বলা হয়েছে, ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে তাদের আপত্তি রয়েছে। সংগঠনের নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করিম বিবৃতি দিয়ে বলেন, “বাংলা নববর্ষ উদযাপনে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে কোনও কিছু করা যাবে না। ‘মঙ্গল’ শব্দ ও ধারণা বাদ দিতে হবে।” উল্লেখ্য, চারুকলা অনুষদ ১৯৮৯ সাল থেকে পয়লা বৈশাখে শোভাযাত্রা করছে। শুরুতে এর নাম ছিল আনন্দ শোভাযাত্রা। নব্বইয়ে নামকরণ হয় মঙ্গল শোভাযাত্রা। ইসলামি আন্দোলনের নেতা ফয়জুল করীম বলেন, “নববর্ষের দিন মানুষ শালীনতা ও ইতিহাস-ঐতিহ্য সমর্থিত পন্থায় নানা আয়োজন করতেই পারে। কিন্তু সেই দিন কোনও যাত্রা করলে তাতে মঙ্গল হবে—এমন বিশ্বাস করলে বা ধারণা করলে, পরিষ্কারভাবে তা অপরাধ হবে। তাই মঙ্গল শোভাযাত্রা নামে কোনও কিছু অবশ্যই করা যাবে না। মঙ্গল শব্দ ও ধারণা অবশ্যই বাদ দিতে হবে।” বিবৃতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে নববর্ষের আয়োজন থেকে মঙ্গল শব্দ ও ধারণা বাদ দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। বলা হয়েছে, ‘নববর্ষের আয়োজনে মূর্তি-সহ ইসলাম অসমর্থিত সবকিছু বাদ দিন। বরং এ দেশের হাজার বছরের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে বিবেচনা করে ইসলাম সমর্থিত ধারণা ও উপকরণ ব্যবহার করুন।’
এই পরিস্থিতিতে সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা মোস্তফা সরয়ার ফারুকী জানিয়েছেন, “শুধু বাঙালি নয়, মঙ্গল শোভাযাত্রায় থাকবে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অংশগ্রহণ। এ বছর দু’দিন ধরে উদযাপিত হবে পয়লা বৈশাখ। চারুকলা থেকে বের হওয়া মঙ্গল শোভাযাত্রার নাম পরিবর্তন হবে কিনা সেটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিদ্ধান্ত নিয়ে আগামী ১০ এপ্রিল জানাবে।” এদিকে, এ বছর পয়লা বৈশাখ শোভাযাত্রায় থাকবে শহিদ আবু সাঈদের বুক চিতিয়ে দাঁড়ানোর ভাস্কর্য। এর দৈর্ঘ্য হবে ২০ ফুট। শোভাযাত্রার আয়োজক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক আজাহারুল ইসলাম এই তথ্য জানান। তিনি বলেন, প্রাথমিকভাবে বড় আকারের চারটি ভাস্কর্য রাখার পরিকল্পনা রয়েছে। এর মধ্যে একটি থাকবে শহিদ আবু সাঈদের। আরও থাকবে স্বৈরাচারের প্রতীকী ভাস্কর্য।
প্রশ্ন হল, বাংলাদেশে জনপ্রিয় পয়লা বৈশাখের মঙ্গল শোভযাত্রাকে আক্রমণ করছে কেন মৌলবাদীরা? কারণ এই শোভাযাত্রা ধর্মীয় পরিচয়কে পিছনে ফেলে বাঙালি আত্মপরিচয়ের সমর্থন যোগায়। পাকিস্তানপন্থী নতুন বাংলাদেশ যেখানে বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমানের অবদান নস্যাৎ করা হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাসকে চাপা দেওয়ার চেষ্টা হচ্ছে, সেখানে মঙ্গল শোভাযাত্রার ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখা বিপজ্জনক শাসকপক্ষের কাছে। তাই মঙ্গলযাত্রাকে ভণ্ডুল করাই ইউনুসপন্থী ও মৌলবাদীদের লক্ষ্য।