স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ৬ জানুয়ারি: সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের গোটা গ্যালারি তখন দাঁড়িয়ে। প্রায় ২৫ হাজার দর্শকের তুমুল করতালিতে প্রকম্পিত চারপাশ। সেখানে সামিল স্ত্রী, সন্তান, স্বজনেরাও। ওয়ার্নার একবার চুলে হাত বুলালেন মাথা নিচু করে। এরপর হেলমেটের সামনে ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়ার প্রতীকে চুম্বন এঁকে দিলেন। হাঁটতে হাঁটতেই দুহাত প্রসারিত করে এবং ব্যাট উঁচিয়ে সবার অভিনন্দনের জবাব দিলেন। এরপর মাঠ ছেড়ে সিড়ি ভেঙে উঠে গেলেন ড্রেসিং রুমে। সাদা পোশাকে শেষবার!ধারাভাষ্যকক্ষের ইসা গুহ দারুণভাবে তুলে ধরলেন মুহূর্তটিকে, ‘গেম ওভার ফর দা গেম চেঞ্জার…।’ওয়ার্নারের ক্যারিয়ারের মূল সুরই তো এটা। খেলার মোড় বদলে দিতেন তিনি। ব্যাট হাতে তার ছন্দে থাকা মানেই খেলাটা নতুন ধাপে পৌঁছে যাওয়া, প্রতিপক্ষের বোলিং ও মনোবল বিধ্বস্ত হওয়া। সেই ব্যাট আর ঝড়ে উত্তাল হবে না সাদা পোশাকে।ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসেও দারুণ সব স্ট্রোক খেলে ওয়ানডের গতিতে ফিফটি ছুঁয়ে দলকে জয়ের কাছে নিয়ে গিয়ে বিদায়বেলা রাঙালেন ওয়ার্নার। ম্যাচ জিতে পাকিস্তানকে ৩-০তে হোয়াইটওয়াশ করল অস্ট্রেলিয়া। সবকিছুই হলো তার ঘরের মাঠে নিজ শহরের দর্শকদের সামনে। ঝলমলে বিদায় তো একেই বলে!আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে তার পদচারণা শুরু হয়েছিল ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে টি-টোয়েন্টি দিয়ে। সেবার তার দলে ডাক পাওয়াটাই তোলপাড় তুলেছিল বেশ। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেই তখনও তার পা পড়েনি! লিস্ট ‘এ’ ম্যাচ ও ঘরোয়া টি-টোয়েন্টি খেলেছেন ততদিনে ১০টি করে। তবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট না খেলেই জাতীয় দলে ডাক পাওয়ার ঘটনা অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটে বিরল।
কেন তাকে আলাদা চোখে দেখছিলেন নির্বাচকরা, সেটি তিনি বুঝিয়ে দেন অভিষেকেই। মেলবোর্ন ক্রিকেট মাঠে মাখায়া এনটিনি, জ্যাক ক্যালিস, ডেল স্টেইনদের গুঁড়িয়ে ৪৩ বলে ৮৯ রানের ইনিংস উপহার দেন অভিষেকেই!প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক হয় মাস দুয়েক পরই। তবে তখনও পর্যন্ত তাকে সীমিত ওভারের ক্রিকেটারই মনে করা হতো। আরও নির্দিষ্ট করে বললে, টি-টোয়েন্টি ব্যাটসম্যান।সেই তিনি পরে আলো ছড়ালেন সাদা পোশাকেও। ক্যারিয়ারের শুরুতে সব সংস্করণেই তিনি ছিলেন মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান। পরে লিস্ট ‘এ’ ক্রিকেটে ওপেনিংয়ে তুলে আনা হয় তাকে। সেখানে দ্বিতীয় ম্যাচেই ১২২ বলে ১৬৫ রানের ইনিংস উপহার দেন। সেটি দেখে টি-টোয়েন্টিতেও ওপেনিংয়ে নামানো হয়। এখানে তৃতীয় ম্যাচে করেন ৩৫ বলে ৬৫। ব্যস, তার পরিচয় হয়ে যায় ওপেনার।সীমিত ওভারে ওপেন করা শুরু করলেও প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে নতুন বলের সামনে তাকে নিয়ে সংশয় ছিল। এখানেও শুরুটা তাই হয় মিডল অর্ডারে। কিন্তু পাঁচটি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে কিছু স্ট্রোকের ঝলক দেখালেও ফিফটি করতে পারেননি একটিও। এখানেও তাকে ভার দেওয়া হয় ইনিংস শুরুর। ওপেনিংয়ে প্রথম সুযোগেই খেলেন ৯৯ রানের ইনিংস, পরেরটিতে করেন সেঞ্চুরি।
পাকাপাকি হয়ে যায় তার পরিচয়। তিন সংস্করণেই ওপেনার। আগ্রাসী ওপেনার।সেই পথ ধরেই ২০১১ সালের ডিসেম্বরে তার টেস্ট অভিষেক নিউ জিল্যান্ডের বিপক্ষে। প্রথম টেস্টে ভালো কিছু করতে না পারলেও পরের ম্যাচেই উপহার দেন সেঞ্চুরি। পঞ্চম টেস্টে ভারতের বিপক্ষে পার্থে খেলেন ১৫৯ বলে ১৮০ রানের ইনিংস। টেস্টেও জায়গা আপন করে নেন।ক্রমেই হয়ে ওঠেন তিন সংস্করণে অস্ট্রেলিয়ার ভরসা। ব্যাটিংয়ের দর্শন সব সংস্করণেই একই- আক্রমণ। নিজের মতো খেলেই তিনি ছাপ রাখেন প্রবলভাবে। প্রতিটি সংস্করণেই সফল আধুনিক ব্যাটসম্যানদের ছোট্ট তালিকায় নিজের নাম লেখান।তার ব্যাটিংয়ের ধরনের কারণেই সবসময় খুব ধারাবাহিক হতে পারেননি। ক্যারিয়ারে দুই দফায় টানা তিন ইনিংসে সেঞ্চুরি করেছেন বটে, তিন দফায় এক ম্যাচে করেছেন জোড়া সেঞ্চুরি। তবে দারুণ ধারাবাহিক খুব একটা হতে পারেননি। ক্যারিয়ারের শুরুর ৬ টেস্ট বাদ দিলে পরের সময়টায় আর কেবল ৭ টেস্টে তার গড় ছিল পঞ্চাশের ওপর। ক্যারিয়ার শেষ করলেন ৪৪.৫৯ গড় নিয়ে। খুব খারাপ না হলেও এই ব্যাটিং গড় অন্য অনেক আধুনিক গ্রেটের তুলনায় হৃষ্টপুষ্ট নয়।
কিন্তু কার্যকারিতায় তার জুড়ি মেলা ভার।তিনি ভালো খেলা মানে নিজ দলের সম্ভাবনা বেড়ে যাওয়া অনেকটাই, তেমনি প্রতিপক্ষও জানত, তাকে দ্রুত ফেরাতে না পারা মানে নির্ঘাত বিপদে পড়া।২৬ সেঞ্চুরিতে ৮ হাজার ৭৮৬ রান নিয়ে তিনি শেষ করলেন টেস্ট ক্যারিয়ার। এর মধ্যে ৩৯ রান ছাড়া বাকি সবই ইনিংসের শুরুতে।ওপেনিংয়ে তার স্ট্রাইক রেট ৭০.৪২। এত দ্রুততায় তার সমান রান করতে পারেননি টেস্ট ইতিহাসের আর কোনো ওপেনার।৮ হাজার রান করা ওপেনারদের মধ্যে তার চেয়ে বেশি স্ট্রাইক রেট আছে কেবল আর একজনেরই। তিনি একদিক থেকে ওয়ার্নারদের ঘরানারই অগ্রদূত- ভিরেন্দার শেবাগ!তারা দুজন ছাড়া আর কোনো ওপেনার ৭০ স্ট্রাইক রেটে আড়াই হাজার রানও করতে পারেননি।আশির বেশি স্ট্রাইক রেটে তিনি ৩৩৫ রানের ইনিংস খেলেছেন, প্রায় ৮৯ স্ট্রাইক রেটে আড়াইশ করেছেন, আশির কাছে স্ট্রাইক রেটে ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন।
একশর বেশি স্ট্রাইক রেটে তার শতরান ৬টি, ওপেনারদের মধ্যে যা যৌথভাবে সর্বোচ্চ শেবাগের সঙ্গে। সব পজিশন মিলিয়েই তাদের চেয়ে বেশি আছে কেবল অ্যডাম গিলক্রিস্টের (৭টি)।সবকিছুতেই ফুটে উঠছে তার ব্যাটিংয়ের ধরন। এভাবে খেলেই তিনি রাঙিয়েছেন, ছাপ রেখেছেন, দলকে জিতিয়েছেন। ‘ম্যাচ উইনার’ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন।এক সময়ের বিস্ফোরক টি-টোয়েন্টি ওপেনার ১১২টি টেস্ট খেলেছেন, নিজেকে তুলে নিয়েছেন অস্ট্রেলিয়ার ইতিহাসের সফলতম টেস্ট ওপেনারের উচ্চতায়। এই গল্পেও মিশে আছে তার জয়গান।হ্যাঁ, অস্ট্রেলিয়ার সেরা ওপেনারদের সঙ্গে তুলনায় বা টেস্ট ইতিহাসের সেরা ওপেনারদের আলোচনায় কিছু খামতির জায়গা তার আছেই। দেশের মাঠে তার ব্যাটিং গড় ৫৭.৮৫, কিন্তু দেশের বাইরে ৩২.৫০। বিশেষ করে ভারতে তার গড় ২১.৭৮, ওয়েস্ট ইন্ডিজে ২৬.৯০, শ্রীলঙ্কায় ২৫.২২।
সবচেয়ে বেশি সমালোচনার মুখে পড়তে হয়েছে তাকে ইংল্যান্ডে পারফরম্যান্সের জন্য। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দেশের আঙিনায় তার গড় ২৬.৪৮। সেখানে ১৯ টেস্ট খেলেও নেই শতরান। সুইং বোলিংয়ের সামনে, বিশেষ করে স্টুয়ার্ট ব্রডের কাছে নাকাল হতে হয়েছে বারবার।আবার সেই তিনিই ২০১৭ সালে বাংলাদেশে ভয়াবহ টার্নিং ট্র্যাকে টানা দুই টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন। ব্যাটিংয়ের জন্য সবচেয়ে কঠিন জায়গাগুলোর একটি মনে করা হয় যেটিকে, সেই দক্ষিণ আফ্রিকায় ৬ টেস্ট খেলে ৩ সেঞ্চুরি, ৪ ফিফটি করেছেন। ব্যাটিং গড় সেখানে ৬৩.৩৩।তবে এসব পরিসংখ্যান, রেকর্ড তো স্রেফ বিশ্লেষণ আর কাটাছেঁড়ার অংশ। নইলে তার কাছে এসবের মূল্য তেমন একটা ছিল না কখনোই। নিজেকে তিনি সেভাবে মেলেও ধরতে চাননি। লোকে তাকে সেভাবে চেনেওনি। তার সবচেয়ে বড় পরিচয় তো, আনন্দদায়ী। টেস্ট ক্রিকেটেও যিনি পসরা মেলে ধরতেন বিনোদনের।বিদায়বেলায় তিনি নিজেও তা বললেন। লোকে কিভাবে মনে রাখবে তাকে? শেষ টেস্ট শেষে এই প্রশ্নে ওয়ার্নার বললেন, “রোমাঞ্চকর ও বিনোদনদায়ী একজন হিসেবে… খেলার ধরন দিয়ে যে লোকের মুখে হাসি ফুটিয়েছে।”