স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক,১৮ জুলাই: এশিয়া, ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্রের বড় অংশ যখন দাবদাহে পুড়ছে, একই সময়ে প্রবল বর্ষণ আর বন্যায় বিপর্যস্ত এশিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকা।যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিম এবং দক্ষিণাঞ্চল সোমবার রেকর্ড তাপমাত্রা দেখেছে, উত্তর-পূর্বের প্রবল বৃষ্টি তৈরি করছে বন্যা পরিস্থিতি; আর মধ্য-পশ্চিমের দমবন্ধ দশা হয়েছে দাবানলের ধোঁয়ায়।রয়টার্স জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের পশ্চিমাংশে যে দাবদাহ বইছে, তার জেরে রোববার ক্যালিফোর্নিয়ার ডেথ ভ্যালি মরুভূমিতে তাপমাত্রা পৌঁছায় ৫৩ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা গত ৯০ বছরে পৃথিবীতে রেকর্ড করা সর্বোচ্চ তাপমাত্রাগুলোর একটি।ফিনিক্সে সোমবার ৪৫.৫ ডিগ্রিতে পৌঁছেছে পারদ, রেকর্ড টানা ১৮ দিন ধরে সেখানে তাপমাত্রা রয়েছে ৪৩ ডিগ্রির ওপরে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস বলছে, আরও অন্তত এক সপ্তাহ এ পরিস্থিতি চলবে।কেবল যুক্তরাষ্ট্র নয়, তীব্র তাপে পুড়ছে উত্তর গোলার্ধের আরো অনেক এলাকা। চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের প্রত্যন্ত শহর সানবাওয়ে তাপমাত্রা পৌঁছেছে ৫২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াসে, যা দেশটির রেকর্ড।
ইউরোপ জ্বলছে দাবানলে, দুই সপ্তাহের মধ্যে দ্বিতীয় দফা তাপপ্রবাহের পূর্বাভাস এসেছে সেখানে, যাতে তাপমাত্রা উঠতে পারে ৪৮ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। এ পরিস্থিতিতে ইতালি ও ফ্রান্স স্বাস্থ্য সতর্কতা জারি করেছে।জাপান, চীন, দক্ষিণ কোরিয়া এবং ভারতের কিছু অংশ এই মাসে প্রবল বর্ষণ দেখেছে। এর জেরে আকস্মিক বন্যা আর ভূমিধস ডেকে এনেছে মৃত্যু, লাখো মানুষের জীবন হয়েছে বিপর্যস্ত।দক্ষিণ কোরিয়ার শহর চেওংজুতে তুমুল বুষ্টির মধ্যে শনিবার একটি বাঁধ উপচে টানেল প্লাবিত হয়ে বহু যানবাহন আটকা পড়ে, মৃত্যু হয় ১৩ জনের।সিএনএন জানিয়েছে, বৃষ্টি, বন্যা আর ভূমিধসের কারণে গত এক সপ্তাহে দক্ষিণ কোরিয়ায় অন্তত ৪১ জনের মৃত্যু হয়েছে, কয়েক হাজার মানুষ তাদের বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বাধ্য হয়েছে।প্রাণঘাতী এই দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল দেশের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কাঠামো ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানিয়েছেন।তিনি সতর্ক করে বলেছেন, “এই ধরনের চরম আবহাওয়ার ঘটনা আগামীতে সাধারণ হয়ে উঠবে, আমাদের অবশ্যই জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টা মেনে নিতে হবে এবং মোকাবেলা করতে হবে।”
দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিবেশী জাপানের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে রেকর্ড বৃষ্টিপাতের ফলে প্রবল বন্যায় কমপক্ষে ছয়জন মারা গেছেন, আরও অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন।জাপানের আবহাওয়া দপ্তরের একজন মুখপাত্র বলেছেন, “এমন বৃষ্টি আগে কখনও হয়নি।” ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার বাসিন্দাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।অতিবৃষ্টি আর বন্যার এমন চিত্র দেখা যাচ্ছে দক্ষিণ ও পূর্ব এশিয়ার পুরো অঞ্চলজুড়ে। দক্ষিণে ফিলিপিন্স এবং কম্বোডিয়ার কিছু অংশে বন্যার কারণে ম্যানিলা ও নম পেনের মানুষকে ভুগতে হয়েছে। রেকর্ড বৃষ্টিপাতে ভারতের কয়েকটি রাজ্যে ঢল আর বন্যায় মারা গেছে কয়েক ডজন মানুষ, জনজীবন হয়ে পড়েছে স্থবির।জীবাশ্ম জ্বালানী পোড়ানোর জেরে পরিবেশে বাড়তে থাকা কার্বন গ্যাস যে জলবায়ু বদলে দিচ্ছে, আর তাতে আরও ঘন ঘন, আরও তীব্র মাত্রার তাপপ্রবাহ হওয়ার ঝুঁকি যে কেবলই বাড়ছে, বিজ্ঞানীরা সে কথা বলে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
এই জলবায়ু বিপর্যয় এড়াতে দ্রুত কার্বন গ্যাস নির্গমণ কমানোর উদ্যোগ নিতে বিশ্বনেতাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছেন তারা।আর ৪৪০ কোটি মানুষের মহাদেশ এশিয়া জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আরো বেশি ঝুঁকিতে আছে, কারণ বন্যা, তাপদাহ, ক্ষরার মত আবহাওয়াজনিত দুর্যোগগুলার পর খাবার পানির সঙ্কট এবং ফসলহানীর মত পরিস্থিতি তৈরি হয়, আর তাতে গতি হারায় অর্থনীতি। গত বছর বিপর্যয় ডেকে আনা বন্যায় পাকিস্তানে ১৭০০ মানুষের মৃত্যু হয়, গৃহহীন হয় লাখ লাখ মানুষ। ফসল নষ্ট হওয়ায় একদিকে মুদ্রাস্ফীতি বেড়েছে। অর্থনীতির যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশটি স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বাজে সময়ের মধ্যে যাচ্ছে। দেশটির প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফ গত বছর সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন, “একটি বিষয় খুব স্পষ্ট: পাকিস্তানে যা ঘটেছে তা কেবল পাকিস্তানে থাকবে না। জলবায়ু পরিবর্তন কোনো দেশকে রেহাই দেবে না।“জাতীয় নিরাপত্তার পুরো সংজ্ঞাই আজ বদলে গেছে। বিশ্ব নেতারা একজোট হয়ে এখনই এ বিষয়ে উদ্যোগী না হলে একদিন যুদ্ধ করার জন্য পায়ের নিচে কোনো পৃথিবী থাকবে না।”