Thursday, November 13, 2025
বাড়িবিশ্ব সংবাদনেপালের অস্থিরতা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে

নেপালের অস্থিরতা দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের দুশ্চিন্তা বাড়িয়েছে

স্যন্দন ডিজিটাল ডেস্ক, ১২ সেপ্টেম্বর।। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর মধ্যে নেপাল তৃতীয় দেশ যেখানে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সহিংস বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে সরকারের পতন ঘটেছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিষেধাজ্ঞাকে কেন্দ্র করে ছড়িয়ে পড়া বিক্ষোভে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে ২০ জনের বেশি নিহত হওয়ার পর নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করেন।

তারপরও বিক্ষুব্ধ জনতা সংসদ ভবনে হামলা চালায়, কয়েকজন রাজনীতিবিদের বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে কারফিউ জারি হয়েছে, সেনাবাহিনী মোতায়েন হয়েছে। কাঠমান্ডুর এই দৃশ্য অনেককে মনে করিয়ে দিচ্ছে গত বছর বাংলাদেশের অস্থিরতা আর ২০২২ সালে শ্রীলঙ্কার সরকার পতনের ঘটনাকে। ফলে নেপালের এই সংকটকে ভারত দেখছে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে। বাংলাদেশ ও শ্রীলঙ্কা ভারতের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ হলেও নেপালের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্ক বিশেষ। ঐতিহাসিক, কৌশলগত, জনগণের সঙ্গে জনগণের সম্পর্কের কারণেই এই বিশেষত্ব।

নেপালে সেনাবহিনীর হাতেই এখন শাসনভার। এ পরিস্থিতিতে শঙ্কার মেঘ জমছে ভারতে। বিশেষ করে সীমান্ত নিয়ে। নেপাল থেকে ভারতে অনুপ্রবেশের আশঙ্কা বাড়ছে। ভারতের পাঁচ রাজ্য- উত্তরাখণ্ড, উত্তরপ্রদেশ, সিকিম, বিহার এবং পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে নেপালের রয়েছে এক হাজার ৭৫০ কিলোমিটারেরও বেশি উন্মুক্ত সীমান্ত। ভারতীয় গণমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হচ্ছে, এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন জেল পালানো বন্দি ভারতে ঢুকে পড়েছিল। তারা হাতেনাতে ধরা পড়েছে সশস্ত্র সীমা বল (এসএসবি) এর কাছে। ফলে সীমান্তের ওপারের পরিস্থিতির দিকে গভীরভাবে নজর রাখছে দিল্লি। নেপালের অস্থির পরিস্থিতিতে দ্রুত প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী।

মোদী এক্সে লিখেছেন, “নেপালের সহিংসতায় হৃদয় ভেঙে গেছে। অনেক তরুণ প্রাণ হারিয়েছেন।” তিনি আরও বলেন, নেপালের স্থিতিশীলতা, শান্তি ও সমৃদ্ধি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”

এরপর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের নিয়ে নিরাপত্তা বৈঠক করেছেন মোদী। ওদিকে, এসএসবি’র কাছে সীমান্ত পরিস্থিতি বর্তমানে কী, তা নিয়ে বিস্তারিত জানতে চেয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়।

২০২২ সালে শ্রীলঙ্কায় জনরোষে তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গোতাবায়া রাজাপাকসের দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়ার ঘটনার মতোই বিশ্লেষকরা বলছেন, নেপালের হঠাৎ এই অস্থিরতায়ও ভারত অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছে।

বিশেষ করে কেপি শর্মা ওলি ভারতে সফর যাওয়ার মাত্র এক সপ্তাহ আগেই আচমকা তার পদত্যাগ পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। নেপালের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে দেশটিতে যে কোন অস্থিরতাই ভারতের জন্য উদ্বেগের কারণ।

নেপাল বিষয়ক বিশেষজ্ঞ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল অশোক মেহতা বিবিসি-কে বলেন, “চীনের ওয়েস্টার্ন থিয়েটার কমান্ড নেপালের অপর প্রান্তেই অবস্থিত। ইন্দো-গাঙ্গেয় সমভূমির প্রবেশপথও নেপালের মধ্য দিয়ে।” নেপালে অস্থিরতার প্রভাব পড়ছে ভারতে থাকা বিপুল সংখ্যক নেপালি প্রবাসীদের ওপরও। ভারতে বসবাস বা কর্মরত আছেন প্রায় ৩৫ লাখ নেপালি। বিশেষজ্ঞদের ধারণা, প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। নেপাল মূলত হিন্দু-সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ এবং সীমান্তপারের সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্ক রয়েছে। ১৯৫০ সালের চুক্তির আওতায় ভিসা বা পাসপোর্ট ছাড়াই নেপালিরা ভারতে কাজ করতে পারেন। এই সুবিধা কেবল নেপাল ও ভুটানের আছে। এছাড়া, বিশেষ চুক্তির আওতায় ৩২ হাজার নেপালি গুর্খা সেনা ভারতীয় সেনাবাহিনীতে কাজ করে।

দিল্লির জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের (জেএনইউ) অধ্যাপক সঙ্গীতা থাপলিয়াল বলেন, “সীমান্ত খোলা থাকায় দুই পাশের পরিবারগুলো নিয়মিতই একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখতে পারে।” নেপালে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ হিন্দু পবিত্র স্থান রয়েছে। এর মধ্যে আছে হিমালয় পর্বতমালার উত্তরে অবস্থিত মুক্তিনাথ মন্দিরও। প্রতিবছর হাজার হাজার তীর্থযাত্রী এই মন্দিরে যান। ওদিকে, কাঠমান্ডু ভারতীয় রপ্তানি পণ্য, বিশেষ করে তেল এবং খাবারের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল। ভারতের সঙ্গে নেপালের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বছরে সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বুধবার কাঠমান্ডুতে আপাতত শান্তি ফিরলেও পরিস্থিতি এখনও নাজুক হওয়ায় ভারতের জন্য কূটনৈতিক ভারসাম্য রক্ষা করা কঠিন হবে। কারণ, নেপালের জনগণ দেশটির তিনটি প্রধান রাজনৈতিক দলকে নিয়েই ক্ষুব্ধ। নেপালের এই তিন দলের সঙ্গেই ভারতের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রয়েছে। দল তিনটি হল: কেপি শর্মা ওলির নেতৃত্বাধীন সিপিএন (ইউএমএল), শের বাহাদুর দেউবার নেতৃত্বাধীন নেপালি কংগ্রেস এবং প্রচণ্ডর নেতৃত্বাধীন সিপিএন (মাওবাদী কেন্দ্র)।

হিমালয়ের দেশ নেপালের কৌশলগত অবস্থানের কারণে ভারত ও চীন দুই দেশই সেখানে প্রভাব বিস্তারের জন্য প্রতিযোগিতা করছে। ফলে এই দুই এশীয় শক্তির দেশ নেপালের অভ্যন্তরীন বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছে বলে অভিযোগ উঠছে। নেপালে ওলির পর কী ধরনের প্রশাসন আসছে, সেটি এখনও অনিশ্চিত। “এজন্যই ভারত সতর্ক থাকবে” জানিয়ে অধ্যাপক সংগীতা ঠাকুরিয়াল বলেন, “ভারত চায় না নেপালের পরিস্থিতি বাংলাদেশের মত হোক।”

বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দিল্লির সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু শেখ হাসিনার পতন এবং তিনি ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর ঢাকা-দিল্লি সম্পর্ক এখন টানাপোড়েনে। হাসিনাকে আশ্রয় দেওয়ার ভারতের সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন প্রশাসনের সঙ্গে দিল্লির সম্পর্কে এই টানাপোড়েন সৃষ্টি হয়েছে।

নেপাল-ভারতের সম্পর্কেও টানাপোড়েন ছিল। দুই দেশের মধ্যে নিজস্ব মতপার্থক্য রয়েছে, যেগুলো এখন আরও সতর্কভাবে সামলাতে হবে। ২০১৯ সালে ভারত একটি মানচিত্র প্রকাশ করলে নেপাল ক্ষুব্ধ হয়। ওই মানচিত্রে চীনের কাছের পশ্চিমাঞ্চলে কাঠমাণ্ডুর দাবি করা অঞ্চলগুলোকে ভারতীয় ভূখণ্ড হিসেবে দেখানো হয়েছিল।

পরে নেপাল পাল্টা মানচিত্র প্রকাশ করে। এতে কূটনৈতিক বিরোধ আরও তীব্র হয়। কারণ, সেই মানচিত্রে বিতর্কিত এলাকাগুলোকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল।

সম্প্রতি ভারত ও চীন নেপালের দাবি করা সীমান্তবর্তী অঞ্চলগুলোর একটিতে বাণিজ্য ফের শুরু করতে রাজি হয়েছে। গত মাসে চীন সফরে গিয়ে ওলি এ নিয়ে আপত্তি তুলেছিলেন। লিপুলেখ পাসকে বাণিজ্যপথ হিসাবে ব্যবহারে আপত্তি জানান তিনি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভারতকে এখন যে কোনও মতপার্থক্য দূর করতে নেপালের নতুন প্রশাসনের সঙ্গে যোগাযোগ করতে হবে এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব নিয়ে ক্ষুব্ধ তরুণ নেপালিদের সঙ্গেও সম্পৃক্ত হতে হবে। দিল্লির নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সঙ্গীতা থাপলিয়াল বলেন, “নেপালে তরুণদের জন্য সুযোগ কম। ভারতের উচিত নেপালি শিক্ষার্থীদের জন্য ফেলোশিপ বাড়ানোসহ আরও বেশি চাকরির সুযোগ দেওয়ার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা। ” দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থা (সার্ক) কার্যত অচল হয়ে যাওয়ায় প্রতিবেশী দেশগুলোতে রাজনৈতিক পরিবর্তন এবং অস্থিতিশীলতা মোকাবেলা করা ভারতের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াতে চলেছে।

পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক তলানিতে, বাংলাদেশের সঙ্গে টানাপোড়েন চলছে, মিয়ানমার গৃহযুদ্ধে জর্জরিত। এমন একটি সময়ে গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো নেপালে সংকট তীব্রতর হয়েছে। ভারতের অশোক মেহতা বলেন, “শক্তিধর রাষ্ট্র হয়ে ওঠার উচ্চাকাঙ্খার কারণে ভারত প্রতিবেশী দেশগুলোর ওপর থেকে নজর সরিয়ে নিয়েছে। কিন্তু ভারতকে এই আকাঙ্খা পূরণ করতে হলে প্রতিবেশী দেশগুলোতে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে হবে।”

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য