স্যন্দন ডিজিটাল ডেস্ক। আগরতলা। ২০ আগস্ট : গত ২৪ ঘন্টায় অতি ভারী বর্ষণে রাজ্যের বিভিন্ন মহকুমা জনজীবন বিপর্যস্ত। বাড়িঘর ছেড়ে মানুষ আশ্রয় নিয়েছে অস্থায়ী শিবিরে। বিভিন্ন স্থানে ধস পড়ে মৃত্যু হয়েছে দুইজনের। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র জলে থৈ থৈ। ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কৃষি জমি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে মানুষের ব্যক্তিগত সম্পত্তির। দ্রুত উদ্ধারের কাজে হাত লাগিয়েছে প্রশাসন। তবে আকাশের মুখ এখনো ভারি। আবহাওয়া দপ্তর বলছে ২৪ ঘন্টা পশ্চিম ত্রিপুরা জেলা, খোয়াই জেলা, দক্ষিণ জেলা এবং সিপাহীজলা জেলায় আরো অতি ভারী বর্ষণের সম্ভাবনা রয়েছে। এর জন্য সতর্কতা জারি করা হয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিণাংশে নিম্নচাপ এবং ঘূর্ণবাতের কারণে এই ভারী বৃষ্টিপাত হচ্ছে। পশ্চিম ত্রিপুরা জেলার আগরতলা শহরের অবস্থাও বেহাল। বিশেষ করে রাজধানীর বনমালীপুর, বলদা খাল, শ্রীলঙ্কা বস্তি, রামঠাকুর পল্লী, কাশিপুর, চন্দ্রপুর, বড়জলা, জয়নগর, প্রতাপগড় সহ বিভিন্ন এলাকা জলে প্লাবিত হয়ে যায়। সোমবার রাতের বেলায় নামানো হয়েছে বোড। মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত চলে মানুষকে বাড়ি ঘর থেকে উদ্ধার করার কাজ। হাওড়া নদীর জল ফুলে উঠে। মানুষ জীবন রক্ষা তাগিদে পরিবারকে নিয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থলের আশায় রওনা হয়। লক্ষ্য করা যায় চন্দ্রপুর সহ আশপাশ এলাকা পুরোপুরি জলমগ্ন। জাতীয় সড়কও জলে নিচে তলিয়ে যায়। জলের নিচে তলিয়ে যায় রাস্তার পাশে থাকা পেট্রোল পাম্প। এক প্রশাসনিক আধিকারিক জানান, জিরানিয়া মহাকুমা প্রশাসন এবং সদর মহকুমা প্রশাসন যৌথভাবে মানুষকে উদ্ধারের কাজে হাত লাগিয়েছে। কাজে কোন ধরনের ভাগাভাগি না করে আগে মানুষের জীবন রক্ষা করছে তারা।
আগরতলা চন্দ্রপুর স্থিত তুষার সংঘ ক্লাবে, রামঠাকুর গার্লস স্কুল, মহাত্মা গান্ধী মেমোরিয়াল স্কুল এবং ধলেশ্বর স্থিত স্বামী দয়ালন্দ বিদ্যালয়ে অস্থায়ী শিবির করা হয়েছে। মানুষকে উদ্ধার করে এই অস্থায়ী শিবিরের আনার জন্য গেলে কেউ কেউ আসতে চাইছে না। বিশেষ করে বলদাখাল এলাকার কিছু মানুষ অবৈজ্ঞানিকভাবে এলাকার একটি ব্রীজের উপর অস্থায়ী শিবির করে থাকে। তারা স্থানীয় কাউন্সিলর সহ প্রশাসনের কথা শুনতে চাইছে না। প্রতিবছর তারা এভাবে প্রশাসনিক কাজে বাধা সৃষ্টি করে। পরবর্তী সময়ে জল বাড়ার ফলে পুনরায় তাদের গিয়ে উদ্ধার করে আনতে হয়। তিনি আরো জানিয়েছেন জল বর্তমানে একে জায়গায় রয়েছে। জল কমার কোন নাম নেই। এদিকে দক্ষিণ চন্দ্রপুর এলাকার কিছু মানুষ জানায় এলাকার প্রায় দুই শতাধিক বাড়ি ঘরে জল প্রবেশ করেছে। পরিস্থিতি উন্নত হওয়ার কোন নাম গন্ধ নেই। বিশেষ করে তারা অভিযোগ জানায় এলাকায় কিছু প্রশাসনিক কাজকর্মের উদাসীনতার কারণে এবং ড্রেইন ভেঙে যাওয়া জল বের হওয়ার রাস্তা খুঁজে পাচ্ছে না। এদিকে খবর পেয়ে ছুটে যায় এলাকার বিধায়ক গোপাল চন্দ্র রায় এবং ৩১ নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর অঞ্জনা দাস।
তাঁরা ক্ষতিগ্রস্তদের সাথে কথা বলে জানান, পরিস্থিতি ধীরে ধীরে নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। তারপরও মানুষকে উদ্ধার করে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। প্রশাসনের পাশাপাশি সাধারণ মানুষও উদ্ধারের কাজে হাত লাগিয়েছে। প্রবল বন্যা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মুখ্যমন্ত্রীও। তিনি সামাজিক মাধ্যমে পোস্ট করে জানিয়েছেন, তীব্র বৃষ্টিপাতের কারণে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলা এবং অন্যান্য জেলাগুলির বেশ কয়েকটি এলাকা বন্যার সম্মুখীন হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা প্রদানের জন্য ত্রাণ কেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে। জননিরাপত্তাকে অগ্রাধিকার দিতে এবং বন্যার প্রভাব প্রশমিত করতে জেলা প্রশাসনকে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এদিকে তেলিয়ামুড়ার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত। প্রায় চার শতাধিক মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে আশ্রয় নিয়েছে শরণার্থী শিবিরে। ধস পড়ে নতুনবাজার – করবুক, যতনবাড়ির রাস্তা বন্ধ বুদ্ধমন্দির এলাকায়। দ্রুত যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে উদ্ধারের কাজে হাত লাগায় প্রশাসন।
গোমতী নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বহু বাড়িঘর জলমগ্ন হয়ে পড়ে।অনেক মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। পার্শ্ববর্তী মহাকুমা করবুকে মাটির ধসে চাপা পড়ে মৃত্যু হল জনজাতি এক বৃদ্ধার। ঘটনা নিউ গোমতি এডিসি ভিলেজের গুড়িনাঙ পাড়া ব্রু পূনর্বাসন কেন্দ্রে। এলাকায় শোকের ছায়া বিরাজ করছে। ঘটনার বিবরনে জানা যায়, মঙ্গলবার ভোর পাঁচটা নাগাদ গুড়িনাঙ পাড়া ব্রু পূনর্বাসন কেন্দ্রের বাসিন্দা রমা রিয়াং এর স্ত্রী মাইয়ি রিয়াং প্রাকৃতিক কাজ করার জন্য বসত ঘরের পার্শ্ববর্তী শৌচালয়ে যায়। তখন হঠাৎ করে শৌচালয় সহ ওই এলাকার মাটি ধসে পড়ে। এতে করে জনজাতি ওই বৃদ্ধাটি মাটির ধসের নিচে চাপা পড়ে যায়। এলাকাবাসীদের দীর্ঘ প্রচেষ্টায় প্রায় সাড়ে চার ঘন্টা বাদে মাটির নিচ থেকে বৃদ্ধার মৃতদেহটি উদ্ধার করতে সক্ষম হয়। খবর পেয়ে প্রশাসনিক আধিকারিকরাও গুড়িনাঙ পাড়া ব্রু পূনর্বাসন কেন্দ্র ছুটে যান। অপরদিকে অবিরাম বর্ষণে মুঙ্গিয়াকামী থানাধীন চামপ্লাই লাখাই বাজারে পাহাড় ভেঙ্গে ঘরের উপর ধস পড়ে মৃত্যু এক ১৪ বছর বয়সী নাবালকের। মৃত নাবালকের নাম বীরেশ দেববর্মা। একই ঘরে ছিল বীরেশের মা এবং বাবা। ঘটনার আগে দুজন প্রাকৃতিক কাজ করতে গেলেই ধ্বস ভেঙ্গে পড়ে ঘরের উপর অল্পেতে বেঁচে যান তারা। খবর পেয়ে মঙ্গলবার সকালে তেলিয়ামুড়ার বন্যা প্লাবিত এলাকা গুলো পরিদর্শনে যান বিধায়িকা তথা রাজ্য বিধানসভার মুখ্য সচেতক কল্যাণী সাহা রায়। বন্যা দুর্গতদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন তিনি।
তিনি জানিয়েছেন গ্ৰামীন এবং পৌর এলাকা মিলিয়ে মোট ৯ টি সরনার্থী শিবির খোলা হয়েছে। সেখানে কয়েক হাজার শরনার্থী আশ্রয় নিয়েছে। লাগতর বর্ষণে কমলপুর ধলাই নদীর জল ফুলে প্লাবিত বহু এলাকা। মানুষের বাড়িঘর ডুবিয়ে ফেলে। বিশেষ করে কমলপুর সুরমা কেন্দ্রের অধিকাংশ এলাকা জলের তলায়। কমলপুরের হালাহালি গ্রামে প্রায় আশি পরিবার বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত। তাদেরকে কমলপুর মাদ্রাসা দ্বাদশ বিদ্যালয়ে ক্যাম্প করে স্থান দেওয়া হয়েছে বলে জানান মহকুমা শাসক এল. ডারলং। পাশাপাশি জলসম্পদ উন্নয়ন দপ্তরের এসিস্ট্যান্ট ইঞ্জনিয়ার বিকাশ মালাকার বলেন বর্তমানে জল চূড়ান্ত বিপদসীমা তথা ৩২.৭০ মিটার ‘র উপর প্রবাহিত হচ্ছে। তবে সুরমা কেন্দ্রের হাল খুব খারাপ। টানা দুই দিনের প্রবল বর্ষণে জনজীবন স্তব্ধ হয়েছে দক্ষিণ ত্রিপুরা জেলাতেও।
গৃহবন্দী বহু পরিবার, গ্রামীন রাস্তা, টিলা ভূমির ধস ভেঙ্গে পড়ে। কোথাও কোথাও রাস্তা পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। প্রশাসনিক সূত্রে খবর, বিলোনিয়া মহকুমার অন্তর্গত রাজনগর ব্লক এলাকার একেবারে উত্তর সীমান্তে যষমুড়া বাজারের উত্তরাংশ দিয়ে পরিমল পালের বাড়ির সামনে দিয়ে যে সড়কটি চিকনতলী গ্রাম হয়ে ওয়াংছরার উত্তরাংশ দিয়ে কাঠালিয়া সাথে যোগাযোগ, এই সড়কটির একাধিক জাগায় ধস ভেঙ্গে পড়ে রাস্তায় একেবারেই বদ্ধ হয়ে গেছে। রাস্তার আশেপাশে যে সমস্ত জনবসতি ওরা এখন ঘর থেকে বেরিয়ে রাস্তায় নেমে আসার ও সুযোগ নেই। শুধু তাই নয়, বিদ্যুৎ পরিবাহী তার মাটিতে গড়াগড়ি করছে। অপরদিকে লক্ষ্য করা যায় বিশালগড়ে জাতীয় সড়কের উপর হাঁটু জল। মানুষের দুর্ভোগ চরণে উঠেছে। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি কখন স্বাভাবিক হবে এ বিষয়ে কোনো কিছুই স্পষ্ট বলা যাচ্ছে না। তবে প্রশাসনিক কর্মীরা দ্রুত উদ্ধারের কাজ শুরু করেছে। বিশাল আকারের গাছ ভেঙে পড়ায় তেলিয়ামুড়ায় জাতীয় সড়কে দীর্ঘ চার ঘন্টা বন্ধ যান চলাচল। দুর্ভোগের শিকার হয় সাধারণ মানুষ।