Saturday, July 27, 2024
বাড়িখেলাঅনেক পথ পেরিয়ে এখন স্বপ্নজগতে হোসেলু

অনেক পথ পেরিয়ে এখন স্বপ্নজগতে হোসেলু

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ৯ মে: শেষ বাঁশি বাজার পর যখন আনন্দে বাঁধনহারা হয়ে যখন ছুটোছুটি করছেন রেয়াল মাদ্রিদের ফুটবলাররা, হোসেলু তখন পড়ে আছেন মাঠে। দুহাতে মুখ ঢেকে উপুড় হয়ে সান্তিয়াগো বের্নাবেউয়ের ঘাসের আশ্রয়ে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন তিনি। একটু পর তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন ফেদে ভালভের্দে, রদ্রিগোরা। কিন্তু হোসেলু তখন যেন এই জগতে নেই। তিনি হয়তো ভেসে বেড়াচ্ছেন স্বপ্নের আকাশে!হোসেলু পরে বললেন, স্রেফ স্বপ্ন নয়, দিনটি তার কাছে আরও বেশি কিছু। তার সুন্দরতম স্বপ্নও এমন মধুর ছিল না। তার ক্যারিয়ার সম্পর্কে জানা থাকলে, এই অনুভূতির সঙ্গেও সম্পৃক্ত হতে পারবেন যে কেউ। 

গত দুই মৌসুমে যে দুই ক্লাবে তিনি খেলেছেন, দুটি ক্লাবই অবনমিত হয়ে গেছে লা লিগা থেকে। এবার রেয়াল মাদ্রিদে তিনি এসেছেন স্রেফ এক মৌসুমের জন্য ধারে। সেই তিনিই চ্যাম্পিয়ন্স লিগের সেমি-ফাইনালে খাদের কিনারায় থাকা দলকে নাটকীয়ভাবে পৌঁছে দিলেন কাঙ্ক্ষিত ঠিকানায়। দ্বিতীয় বিভাগে নেমে যাওয়া দল থেকে এসে এই ৩৪ বছর বয়সে রেয়াল মাদ্রিদের মতো ক্লাবের স্মরণীয় জয়ের নায়ক, এসব তো রূপালি পর্দার গল্প। কিংবা রূপকথা।  রেয়ালের সঙ্গে তার সম্পর্ক অনেক পুরোনো। ক্যারিয়ারের নানা বাঁকে এরকম সম্পর্ক হয়েছে অনেক ক্লাবের সঙ্গেই। কিন্তু লম্বা সময় থিতু হতে পারেননি কোথাও। ১২ বছর বয়সে সেল্তা ভিগোর একাডেমিতে পা রাখেন তিনি। এই ক্লাবের হয়েই শীর্ষ পর্যায়ের ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু তার ১৮ বছর বয়সে। ২০০৯ সালে তিনি চলে আসেন রেয়াল মাদ্রিদে। শুরুতে ঠাঁই পান রেয়ালের ‘বি’ দলে। ২০১০-১১ মৌসুমে রেয়ালের ‘বি’ দলে তিনি ছিলেন সর্বোচ্চ স্কোরার। ২০১১ সালে রেয়ারের মূল দলের হয়ে অভিষেকের স্বাদও পেয়ে যান। কারিম বেনজেমার বদলি হিসেবে একটি ম্যাচে শেষ ১০ মিনিটে মাঠে নামেন এবং ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর ক্রস থেকে গোলের দেখাও পেয়ে যান। 

রেয়ালের ‘বি’ দলের হয়ে পরের মৌসুমেও ২৬ গোল করেন তিনি। কিন্ত তারকায় ঠাসা মূল দলে জায়গা পাচ্ছিলেন না। ২০১২ সালে তিনি পাড়ি জমানে বুন্ডেসলিগায়। সেখানে হফেনহাইম, আইনট্রাখট ফ্র্যাঙ্কফুর্ট ও হ্যানোভার হয়ে ২০১৫ সালে ইংলিশ ফুটবলে আসেন স্টোক সিটির হয়ে খেলতে। যথারীতি থিতু হতে পারেননি সেখানেও। ধারে স্পেনে ফেরেন দেপোর্তিভো লা করুনিয়ার হয়ে খেলতে। সেখান থেকে আবার ইংল্যান্ডে নাম লেখান নিউক্যাসল ইউনাইটেডে। এখানেও নিয়মিত হতে পারেননি। ২০১৯ সালে নিজ দেশে ফেরেন আলাভেসের হয়ে খেলতে। এই ক্লাবেই একটু নিয়মিত খেলার সুযোগ করে নেন। পয়েন্ট তালিকার তলানিতে থকে ২০২২ সালে ক্লাবটি নেমে যায় লা লিগা থেকে। 

হোসেলু তখন চলে আসেন এস্পানিওলে। দারুণ পারফর্মও করেন এই ক্লাবের হয়ে। কিন্তু দলের অবস্থা ছিল শোচনীয়। গত মৌসুমে এই ক্লাবের অবনমন হয় লা লিগা থেকে। তবে এটিই তার জন্য শাপেবর হয়ে আসে। গোল স্কোরিং সামর্থ্য দিয়ে তিনি নজর কাড়তে পেরেছিলেন। তার দিকে চোখ পড়ে রেয়ালের। বেনজেমা চলে যাওয়ার পর তারকা কোনো ফরোয়ার্ড দলে আনেনি ইউরোপের সফলতম ক্লাবটি। ঠেকার কাজ চালানোর একজন স্ট্রাইকার তারা খুঁজছিল। সেটিই হোসেলুর জন্য খুলে দেয় রেয়ালে ফেরার দুয়ার।যে বেনজেমার বদলি হিসেবে তিনি রেয়ালের হয়ে প্রথমবার মাঠে নেমেছিলেন, সেই বেনজেমার বদলি হিসেবেই ১২ বছর পর আবার ফেরেন এই আঙিনায়। 

এত বড় ক্লাবে যে তিনি অপাংক্তেয় নন, তা প্রমাণ করেছেন মৌসুমজুড়েই। মাঠে নামার সুযোগ খুব বেশি পাননি। তবে নানা সময়েই রেখেছেন উল্লেখযোগ্য অবদান। করেছেন গুরুত্বপূর্ণ গোল। তবে সব ছাপিয়ে গেলেন বুধবার বায়ার্ন মিউনিখের বিপক্ষে সেমি-ফাইনালে।দল যখন হারের শঙ্কায়, বের্নাবেউয়ের গ্যালারিতে রেয়ালের সমর্থকেরা যখন উৎকণ্ঠায়, আনচেলত্তি তখন হোসেলুর দুয়ারে কড়া নাড়লেন। কোচের প্রত্যাশাকে দু হাতে আলিঙ্গন করে দলকে সমতায় ফেরালেন তিনি ৮৮তম মিনিটে। শেষ নয় সেখানেই। মিনিট তিনেক পরই আরেকটি গোল করে দলকে এনে দিলেন অসাধারণ এক জয়।রেয়ালের আরও একটি প্রত্যাবর্তনের গল্প এবং সেই গল্পের নায়ক ধারে আসা ফুটবলার।

হোসেলু অবশ্য নিজেকে নায়ক-টায়ক বলতে নারাজ। বরং দলের চিরায়ত চরিত্র নিজের মধ্যে ধারণ করতে পেরে তিনি উচ্ছ্বসিত। “নায়ক বা এসব কিছু একদমই বুঝি না, তবে আমি খুবই খুশি… আমাকে দেখে ধারণা করে নিতে পারেন। অবিশ্বাস্য ছিল এটি, অসাধারণ কিছু…।”“এই দল কখনোই হাল ছাড়ে না। দলের রক্তেই এটা আছে যে, শেষ পর্যন্ত লড়াই করে এবং আজকে আমরা সেটিই করেছি।”হোসেলু নিজেকে নায়ক মনে না করলেও তাকে সেই কৃতিত্ব দিয়ে রাখলেন সতীর্থ জুড বেলিংহ্যাম। “আমার মনে হয় না, আজকে রাতে হোসেলু ঘুমাতে পারবে! (এত আলোচনা-প্রশংসা) সবকিছুই তার প্রাপ্য। মৌসুমজুড়েই স্কোয়াডের অসাধারণ এক সদস্য সে এবং আজকের রাতটি তারই।”

শুধু এই ম্যাচই নয়, মৌসুমজুড়ে হোসেলুর পারফরম্যান্স আর তার মানসিকতার কথা তুলে ধরলেন কোচ কার্লো আনচেলত্তি। “এই দলটা কেমন, সেটির প্রতিফলনই পাওয়া যায় তার (হোসেলু) মধ্যে। গোটা মৌসুমে সুযোগ খুব বেশি পায়নি, কিন্তু দলের জন্য করেছে অনেক কিছু। পুরো স্কোয়াডেরই উপযুক্ত উদাহরণ সে… সবাই এরকম দুর্দান্ত পারফর্ম করে যায়, কখনোই আত্মবিশ্বাস হারায় না। সবাই জানে, যে কোনো সময় দলে অবদান রাখতে পারে।”হোসেলু অত কিছু ভাবছেন না। হয়তো ভাবতে পারছেন না। তিনি শুধু জানেন, কল্পনার তুলিতে যত ছবি তিনি এঁকেছেন, কোনোটিই এত চমৎকার ছিল না। 

“প্রথম গোলটি ছিল স্রেফ চটপটে থাকার ব্যাপার। এরকম একটি মুহূর্তের জন্য তৈরি ছিলাম… কারণ, বুঝতে পারছিলাম, ওরা ক্লান্ত। তার পর দ্বিতীয় গোলও এলো।”“এই ধরনের পারফরম্যান্সের স্বপ্ন সবাই দেখে। কিন্তু আজকে যা হলো, আমার সুন্দরতম স্বপ্নেও কখনও এটা ভাবতে পারিনি…।”২০১২ সালে রেয়াল থেকে চলে গেলেও এই ক্লাবকে হোসেলু হৃদয়ে ধারণ করতেন। রেয়ালের জার্সি গায়ে চাপিয়ে ২০২২ চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনালে দর্শক হয়ে গ্যালারিতে ছিলেন তিনি প্যারিসে। তার সুদূরতম কল্পনাতেও নিশ্চয়ই ছিল না, দুই বছর পর তার নাটকীয় দুই গোলে আরেকটি ফাইনালে খেলবে রেয়াল!বাস্তব কখনও কখনও এমনই, কল্পনার চেয়েও চমকপ্রদ। জীবন মাঝেমাধ্যেই যেমন ভাবনার চেয়ে সুন্দর।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য