স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ৬ মে: আর্জেন্টিনার প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের নেপথ্য নায়ক সেসার লুইস মেনোতি আর নেই। আর্জেন্টাইন ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন জানিয়েছে, সোমবার মারা গেছেন কিংবদন্তি এই কোচ। তার বয়স হয়েছিল ৮৫ বছর।রক্তস্বল্পতা ও নানা শারীরিক জটিলতা নিয়ে মাসখানেক ধরেই হাসপাতালে ছিলেন মেনোতি। নানা রোগের সঙ্গে লড়ছিলেন অনেক দিন ধরেই। নিজেকে অনেকটা আড়ালেও রেখেছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে। এবার তিনি চলে গেলেন লোকান্তরে।তার কোচিংয়ে ১৯৭৮ বিশ্বকাপ জয় করে দীর্ঘদিনের আক্ষেপ ঘোচায় আর্জেন্টিনা। পরের বছর যুব বিশ্বকাপেও (অনূর্ধ্ব-২০) তার কোচিংয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় তারা। ওই যুব বিশ্বকাপে অসাধারণ পারফর্ম করে বিশ্ব ফুটবলে নিজের আগমনী বার্তা ভালোভাবে জানান দেন দিয়েগো মারাদোনা। এর আগেই অবশ্য মেনোতির হাত ধরে আর্জেন্টিনা দলে অভিষেক হয় ১৬ বছর বয়সী মারাদোনার।
সেসার লুইস মেনোতির জন্ম ১৯৩৮ সালে রোসারিওতে। খেলোয়াড়ি জীবনে ছিলেন স্ট্রাইকার। খুব উল্লেখ করার মতো নয় তার খেলোয়াড়ি জীবন। রোসারিও সেন্ত্রালের হয়ে ক্যারিয়ার শুরু করেন ১৯৬০ সালে। বছর তিনেক ছিলেন এখানে। এই ক্লাবেই কেবল একটু নিয়মিত খেলার সুযোগ পান। পরে আরও বছর সাতেক খেলেছেন পাঁচটি ক্লাবে। কোথাও নিয়মিত হতে পারেননি। জাতীয় দলের হয়ে খেলেছেন ১১টি ম্যাচে। ১৯৭০ সালে খেলা ছেড়ে নাম লেখান কোচিংয়ে। এখানেই তিনি হয়ে ওঠেন কিংবদন্তি।নিউয়েলস ওল্ড বয়েজের হয়ে তার কোচিং ক্যারিয়ার শুরু। পরের বছর নাম লেখান উরাকানে। তার কোচিংয়ে ১৯৭৩ সালে আর্জেন্টাইন চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করে উরাকান। ১৯৭৪ সালে তিনি দায়িত্ব নেন আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের। দীর্ঘদিন ধরে দলকে গড়ে তোলেন বিশ্বকাপের জন্য এবং দেশের মাঠে ১৯৭৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় আর্জেন্টিনা।
যদিও সামরিক শাসনের অধীনে তার জাতীয় দলের কোচিং চালিয়ে যাওয়া নিয়ে বিতর্ক হয়েছিল। আর্জেন্টিনার সেই বিশ্বকাপ জয় নিয়েও নানা প্রশ্ন আছে ঐতিহাসিকদের। তবে কোচ হিসেবে মেনোতির আবেদন নিয়ে প্রশ্ন নেই। সেই সময়ের ১৭ বছর বয়সী মারাদোনাকে তিনি বিশ্বকাপ দলে নেননি বলেও আর্জেন্টিনায় আলোচনা হয়েছিল তুমুল। তিনি পরে ব্যাখ্যা করেছিলেন, এত কম বয়সী একজনের ভবিষ্যতের সুরক্ষার জন্যই তিনি বিশ্বকাপে নেননি।১৯৭৯ সালে যুব বিশ্বকাপেই মেনোতির কোচিংয়ে প্রতিভার ঝলক দেখিয়ে টুর্নামেন্টের সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন মারাদোনা।শারীরিক গড়ন হালকা-পাতলা ছিল বলে তার ডাক নাম হয়ে গিয়েছিল ‘এল ফ্লাকো’ (লিকলিকে)।
১৯৮২ বিশ্বকাপেও মেনোতি ছিলেন কোচ। আর্জেন্টিনা এবার প্রথম ম্যাচেই হেরে যায় বেলজিয়ামের কাছে। পরে হাঙ্গেরি ও এল সালভাদরকে হারিয়ে গ্রুপ পর্বে উতরে গেলেও পরের রাউন্ডে ব্রাজিল ও ইতালির কাছে হেরে বাদ পড়ে যায়। বিশ্বকাপ শেষে মেনোতির জাতীয় দলের দায়িত্বও শেষ হয়।দেশের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী কোচ ছাড়াও আরেকটি কারণে আর্জেন্টিনার ফুটবলে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন মেনোতি। একসময় যে দল শারীরিকভাবে আগ্রাসী ও মারদাঙ্গা ফুটবল খেলতে অভ্যস্ত ছিল, সেই আর্জেন্টিনাকে নান্দনিক ও আকর্ষণীয় ফুটবল খেলতে শুরু করে তার কোচিংয়েই। তার সেই ধারাই পরে যুগ যুগ ধরে অনুসরণ করে আর্জেন্টিনা।
১৯৮২ বিশ্বকাপের পর ক্লাব কোচিংয়ে ফিরে বার্সেলোনার দায়িত্ব নেন তিনি। তার কোচিংয়ে ১৯৮৩ সালে কোপা দেল রে ও স্প্যানিশ সুপার কাপ জেতে কাতালানরা। এরপর দীর্ঘ কোচিং ক্যারিয়ারে বোকা জুনিয়র্স, আতলেতিকো মাদ্রিদ, মেক্সিকো জাতীয় দল, সাম্পদোরিয়াসহ আর্জেন্টিনা, মেক্সিকো ও উরুগুয়ের বিপক্ষে ক্লাবকে কোচিং করান। সবশষ ২০০৭ সালে মেক্সিকোর ক্লাব তাকোস এফসির দায়িত্বে ছিলেন।২০১৯ থেকে গত বছর পর্যন্ত আর্জেন্টিনা জাতীয় দলের পরিচালকদের একজনও ছিলেন তিনি।মেনোতির মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন আর্জেন্টিনার ২০২২ বিশ্বকাপ জয়ের নায়ক লিওনেল মেসি, দেশের প্রেসিডেন্ট হাভিয়ের মিলেই, আরও অনেক ফুটবল ব্যক্তিত্ব ও তার সাবেক ক্লাবগুলোর প্রায় সবকটি।