Friday, July 25, 2025
বাড়িখেলাজোসেলু—স্টোক সিটির বেঞ্চ থেকে রিয়ালে বেনজেমার বিকল্প

জোসেলু—স্টোক সিটির বেঞ্চ থেকে রিয়ালে বেনজেমার বিকল্প

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক,২৪ জুন: জীবন আসলেই বৈচিত্র্যময়।২০১৬ সালের আগস্ট। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের দল স্টোক সিটি সেদিন লিগ কাপে দ্বিতীয় রাউন্ডের ম্যাচ খেলতে ইংলিশ ফুটবলে চতুর্থ স্তরের দল স্টিভেনজের মুখোমুখি হয়েছিল। স্টোকের বেঞ্চে সেদিন এমন একজন খেলোয়াড় ছিলেন, নিজের ক্যারিয়ারের গতিপথ নিয়ে যাঁর কোনো ধারণা ছিল না। নাম তাঁর জোসেলু। পরিচিত লাগছে? কিছুদিন আগেও তাঁর নামটা সেভাবে উচ্চারিত হয়নি। পাঁচ দিন আগে রিয়াল মাদ্রিদ তাঁকে নিজেদের খেলোয়াড় হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার পর প্রশ্ন উঠেছে কে এই জোসেলু?

সেই মৌসুমের প্রসঙ্গে ফেরা যাক। স্টোকের হয়ে সে মৌসুমে লিগে মিডলসবরো ও ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষেও স্কোয়াডে ছিলেন না জোসেলু। স্টিভেনজের বিপক্ষে ৪–০ গোলে জয়ের ম্যাচেও বেঞ্চ থেকে তাঁকে মাঠে নামানো হয়নি। চার দিন পর এভারটনের মুখোমুখি হয়ে স্টোকের লিগে ফেরার ম্যাচে জায়গাই পেলেন না স্কোয়াডে। এরপর এক সপ্তাহের মধ্যেই ছাড়লেন ক্লাব। কিন্তু সাত বছর পর কি দেখা যাচ্ছে?জোসেলু এখন বিশ্বের অন্যতম সেরা ক্লাবের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়।জোসেলু যখন স্টোকে খেলতেন, তখন ক্লাবটির গোলকিপার ছিলেন শায়ে গিভেন। তাঁর কাছে জোসেলুর গল্পটা ব্রিটিশ কমিক স্ট্রিপ ‘রয় অব দ্য রোভার্স’–এর মতো—এক কাল্পনিক ফুটবল চরিত্রকে নিয়ে গল্প। গিভেনের ভাষায়, ‘ওর গল্পটা রয় অব দ্য রোভার্সের মতোই। একসময় আপনি স্টিভেনজের বেঞ্চে ছিলেন। এরপর চোখ বুজে ছিলেন। চোখে খুলে দেখলেন আপনি রিয়াল মাদ্রিদে সই করার সঙ্গে স্পেন জাতীয় দলেও খেলছেন।’শুধু স্টোক নয়, ২০১৭ সালে ক্লাবটি ছেড়ে নিউক্যাসল ইউনাইটেডেও দুই মৌসুম ছিলেন জোসেলু। সেখানে আক্রমণভাগে তাঁর চেয়ে আলেক্সান্দার মিত্রোভিচকেই বেশি পছন্দ ছিল কোচের। তখন তাঁর বয়স ২৯—এই বয়সে অনেক ফুটবলারই তাঁর সেরা সময় কাটান কিংবা ওই সময়টা পেছনে ফেলে আসেন। কিন্তু জোসেলুর জীবনে একাদশে বৃহস্পতি ধরা দিয়েছে সেই সময় ফেলে আসার পর।

এ বছর ইউরো বাছাইপর্বে নরওয়ের বিপক্ষে স্পেন জাতীয় দলে তাঁর অভিষেক, সেটি তাঁর ৩৩তম জন্মদিনের দুই দিন আগে। ৮১ মিনিটে যখন বদলি হিসেবে নামলেন, ২০০৬ সালের পর স্পেনের সবচেয়ে বয়স্ক খেলোয়াড় হিসেবে অভিষেকের রেকর্ডটি তাঁর নামের পাশে লেখা হয়ে যায়। এরপর ৩ মিনিটের মধ্যে গোলও করেন। পরে আরও একটি!ওই ম্যাচের পর জোসেলু বলেছিলেন, ‘বয়স আমার কাছে কোনো সমস্যা না। নিজেকে ১৮ বছর বয়সী মনে হয়।’গত রোববার নেশনস লিগের ফাইনালে ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষেও বদলি হয়ে মাঠে নেমেছিলেন জোসেলু। টাইব্রেকারে গোলও করেন। এর দুই দিন পরই যোগ দিলেন রিয়াল মাদ্রিদে। করিম বেনজেমার শূন্যতা পূরণে তাঁকে দলে ভিড়িয়েছে রিয়াল মাদ্রিদ। বেনজেমা রিয়ালে পাঁচবার চ্যাম্পিয়নস লিগজয়ী, ব্যালন ডি’অর জিতেছেন—তাঁর শূন্যতা পূরণে রিয়াল এমন একজনকে সই করিয়েছে সাত–আট বছর আগেও যে কি না স্টোকের পছন্দের তালিকায় ৬ কিংবা ৭ নম্বর ফরোয়ার্ড ছিলেন। গিভেনের ভাষায়, জোসেলুর গল্পটা ঘুরে দাঁড়ানোর উদাহরণ। তরুণেরা এখান থেকে শিখতে পারে, কোনো ক্লাবে জায়গা পোক্ত করতে না পারলেই সবকিছু শেষ হয়ে যায় না। দুনিয়ায় আরও ক্লাব আছে যেখানে সুযোগ থাকে।জোসেলু সে সুযোগেরই সন্ধান করেছেন। ২০১৭ সালে নিউক্যাসল তাঁকে ৫০ লাখ পাউন্ডে কিনে নেয়। নিউক্যাসল খরচে মিতব্যয়ী হওয়ার চেষ্টা করছিল, তাই জোসেলুর মতো সাদামাটা কাউকে নিয়ে আসা হয়েছিল। সংবাদমাধ্যম ‘দ্য অ্যাথলেটিক’কে বিষয়টি বুঝিয়েছেন তখন নিউক্যাসলের কোচ রাফায়েল বেনিতেজ, ‘তখন নিউক্যাসলে আমরা বেশি টাকা দিয়ে খেলোয়াড় কেনার চেষ্টা করিনি। এটা অনেকটাই গাড়ি কেনার মতো ব্যাপার। টাকা থাকলে ভালো ব্র্যান্ডেরটা কিনতে পারবেন। টাকা না থাকলে হয়তো কাজ চালানোর মতো কিছু কিনতে পারবেন, তবে সেটা অতটা আকর্ষণীয় ও গতিময় হবে না।’

জোসেলুর ক্ষেত্রেও তা–ই ঘটেছে নিউক্যাসলে। সেখানে দুই মৌসুমে ৫২ ম্যাচে করলেন ৭ গোল, এর মধ্যে প্রায় অর্ধেকসংখ্যক ম্যাচেই নেমেছেন বেঞ্চ থেকে। নিউক্যাসলে যোগ দেওয়ার আগে হফেনহেইম ও হ্যানোভারে ছিলেন, শুধু কি তাই ২০০৯ থেকে ২০১২ সাল পর্যন্ত ছিলেন রিয়ালেই। ‘বি’ থেকে সুযোগ পেয়েছিলেন রিয়ালের মূল দলেও। দুই মৌসুম মিলিয়ে রিয়ালের মূল দলের হয়ে ম্যাচ খেলেছেন মাত্র ১টি। ২০১২ সালে তাঁকে হফেনহেইমের কাছে বেচে দেয় রিয়াল। হফেনহেইম ও হ্যানোভারেও প্রথম একাদশে নিয়মিত হতে পারেননি।১১ বছর পর সেই জোসেলুই যখন কিছুদিন আগে রিয়াল সভাপতি ফ্লোরেন্তিনো পেরেজের পাশে দাঁড়িয়ে জার্সি হাতে পোজ দিলেন, তখন প্রশ্ন উঠতে পারে ৩৩ বছর বয়সী এই ফরোয়ার্ডের ক্যারিয়ারে কি চক্র পূরণ হলো? ১১ বছর আগে ছিলেন মূলত রিয়ালের ‘বি’ দলের খেলোয়াড়। ২০১১ সালে মূল দলের হয়ে দুটি ম্যাচে বদলি হয়ে মাঠে নেমেছিলেন। জোসেলুর ভাবনাও ঠিক বাকিদের মতো নয়। একটা গল্প বলা যায়। স্টোকে থাকতে একদিন অনুশীলনে স্থানীয় সংবাদমাধ্যম ‘স্টোক সেন্টিনেল’–এর এক সংবাদকর্মী তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, ক্লাব–সতীর্থ জোনাথন ওয়াল্টার্স না ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো—কে সেরা? জোসেলু বলেছিলেন, ‘রোনালদো নায়ক। জোনাথন সুপারম্যান।’

জোসেলুর ক্যারিয়ারকে একলহমায় বুঝতে স্টোকের ভক্ত ও লেখক সাইমন লোর কথা শোনা যেতে পারে, ‘এত দেরিতে তার ক্যারিয়ারের ঊর্ধ্বগতিটা অবিশ্বাস্য। স্বীকার করতেই হবে যখন আমি তাকে স্পেনের জার্সিতে খেলতে দেখলাম, তখন নিশ্চিত হতে হয়েছে এটা সে কি না। ভেবেছিলাম অবসর নিয়েছে। কিন্তু ৩৩ বছর বয়সে সে রিয়ালে ফিরেছে। অবিশ্বাস্য গল্প!’ স্টোকসকে নিয়ে ১২টি বইয়ের লেখা সাইমন লোর মতে জোসেলু দুর্ভাগাও, ‘সে স্টোকে এমন এক সময়ে ব্যাকআপ স্ট্রাইকার হিসেবে এসেছিল যখন আমাদের সোনালি সময়—আক্রমণভাগে বোয়ান কিরকিচ, জাদরান শাকিরি ও মার্কো আরনাউতোভিচ। এ ছাড়া জন ওয়াল্টার্স, মামে বিরাম দিউফ ও পিটার ক্রাউচও ছিলেন সে সময়। সব মিলিয়ে জোসেলু সম্ভবত স্কোয়াডের ৭ নম্বর স্ট্রাইকার ছিলেন। তার চলে যাওয়াটা তাই সেভাবে কারও নজরে পড়েনি। এ কারণেই এখন যা ঘটছে, সেটা সবার কাছে অবিশ্বাস্য লাগছে।’নিউক্যাসল ছেড়ে ২০১৯ সালে আলাভেসে ২০ লাখ পাউন্ডে যোগ দেওয়ার পর জোসেলুর ক্যারিয়ারের গতিপথ ঘুরতে শুরু করে। সেখানে তিন মৌসুমেই গোলসংখ্যা দুই অঙ্কে নিয়ে যান। আলাভেস কোচ হাভি কালেয়া তখন বলেছিলেন, ‘ইউরোপের অন্যতম সেরা সেন্টার ফরোয়ার্ড এখন আমাদের দলে। সে দিন দিন আরও উন্নতি করছে।’

আলাভেস ছেড়ে গত বছর এস্পানিওলে যোগ দেন জোসেলু। গত মৌসুমে ক্লাবটির হয়ে ৩৪ ম্যাচে করেন ১৬ গোল, যা তাঁর ক্যারিয়ারেরই সেরা মৌসুম। শুধু করিম বেনজেমা ও রবার্ট লেভানডফস্কি তাঁর চেয়ে গত মৌসুমে লা লিগায় বেশি গোল করতে পেরেছেন। লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা স্প্যানিশ হিসেবে তাই জারা ট্রফিটা উঠেছে জোসেলুর হাতে। ৬ ফুট ৪ ইঞ্চি উচ্চতার এই ফরোয়ার্ড গত মৌসুমে বাতাসে ১৪৬ বার বল দখলের লড়াইয়ে জিতেছেন। লা লিগার গত মৌসুমে যা দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।রিয়ালে ১৪ নম্বর জার্সি পরবেন জোসেলু। এই জার্সি আগে পরেছেন গিওর্গি হ্যাজি, রাউল, গুতি, কাসেমিরোর মতো ফুটবলাররা। অথচ এই খেলোয়াড়টি কয়েক বছর আগেও ইংল্যান্ডে লিগ কাপে চতুর্থ স্তরের দলের বিপক্ষে বসে থাকতেন বেঞ্চে। জোসেলুর ক্যারিয়ার সেখান থেকে ১৮০ ডিগ্রি ঘুরে যাওয়ায় তাঁকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন রিয়ালেরই সাবেক কোচ রাফায়েল বেনিতেজ, ‘রিয়াল মাদ্রিদের মতো দলে, যারা সব সময় আক্রমণ করতে ভালোবাসে, সেখানে বাতাসে সে হুমকি হবে প্রতিপক্ষের জন্য। সে ৪০ মিটার দূর থেকে দৌড়ে সবাইকে পেছনে ফেলে গোল করার মতো খেলোয়াড় নয়। কিন্তু বক্সে কিংবা তার আশপাশে থাকলে গোল করতে পারে।’গোলই চায় রিয়াল। জোসেলু তাঁর ক্লাবের প্রত্যাশার প্রতিদান দিতে পারবেন কি না, তা সময়ই বলে দেবে।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য

error: <b>Alert: </b>Content selection is disabled!!