স্যন্দন ডিজিটাল ডেস্ক, আগরতলা,১ ডিসেম্বর: পোল্যান্ডের বিপক্ষে ২-০ গোলের জয়ে প্রতিপক্ষের রক্ষণে ভীতি ছড়ান আলভারেস। দলকে চালকের আসনে বসানো দ্বিতীয় গোলটি করেন ম্যানচেস্টার সিটির ২২ বছর বয়সী এই স্ট্রাইকার। টানা দুই জয়ে ‘সি’ গ্রুপের সেরা হয়ে নকআউট পর্ব নিশ্চিত করে আর্জেন্টিনা।প্রথম পছন্দের স্ট্রাইকার মার্তিনেসের জায়গায় আলভারেসের শুরুর একাদশে থাকা অনেকের জন্যই বড় চমক হয়ে আসে। তবে ক্লাব ফুটবলে যারা তাকে দেখেছেন, তাদের জন্য হয়তো এটা স্বাভাবিকই। রিভার প্লেটে এক সময় আলো ছড়ানো এই তরুণ এবার বিশ্ব মঞ্চে দিয়েছেন নিজের আগমণী বার্তা। করদোবার এক মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া আলভারেস ছেলেবেলা থেকেই হাসিখুশি স্বভাবের, প্রাণবন্ত। নাদুস-নুদুস গালভরা মিষ্টি হাসিতে মাতিয়ে রাখতেন বাড়ির চৌহদ্দি। পরিবারটিও ফুটবলপ্রেমী। তাই ছয়-সাত বছর বয়সে তার ফুটবলের আঙিনায় পা রাখা।প্রতিপক্ষের গোলমুখে আক্রমণের জাল বিছিয়ে রাখতে আলভারেস এমনই পারদর্শী যে, রিভার প্লেটে খেলার সময় দলটির সমর্থকরা তাকে ডাকত, ‘লা আরানা’ বা ‘দা স্পাইডার’ বলে। দোহার স্টেডিয়াম ৯৭৪-এর আঙিনায় পোল্যান্ডের বিপক্ষে শুরু থেকে আক্রমণের জাল বিছানোর ছক কষেছিলেন আর্জেন্টিনা কোচ লিওনেল স্কালোনি।সেই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য দীর্ঘ দিনের সতীর্থ দি মারিয়া ও তরুণ আলভারসেকে নিয়ে শুরু থেকে একের পর এ আক্রমণ করলেন মেসি। কেবল গোলটাই পেলেন না এই জাদুকর। তার উপর করলেন পেনাল্টি মিস। এমন ঘোরতর বিপদে আলেক্সিস মাক আলিস্তেরের গোল এলো স্বস্তির পরশ হয়ে। এরপর আলভারেসের ঠাণ্ডা মাথার গোল কিছুটা দোদুল্যমানতায় দুলতে থাকা আর্জেন্টিনার পালে বইয়ে দিল স্বস্তির সুবাতাস।
৬৭তম মিনিটে গোলটি ম্যানচেস্টার সিটি ফরোয়ার্ড করেন পরিপক্কতার ছাপ রেখে। মেক্সিকো ম্যাচের গোলদাতা এনসো ফের্নান্দেস বল বাড়ান বক্সে, তা আয়ত্তে নিতে পোলিশ ডিফেন্ডারদের চ্যালেঞ্জের মুখে মোটেও ভড়কে যাননি আলভারেস। প্রথম আলতো ছোঁয়ায় বলের নিয়ন্ত্রণ নেন, বাঁ পায়ের টোকায় বানিয়ে নেন জায়গা এবং এরপর দুম করে নেন শট। চোখের পলকে বল লুটোপুটি খায় জালে। ঝঞ্জাবিক্ষুব্ধ সাগর পেরিয়ে কাঙ্ক্ষিত বন্দরে পৌঁছানোর আগাম আনন্দে কেঁপে ওঠে গ্যালারি।নিজের কাজটুকু করে দিয়ে, স্কোরলাইন ২-০তে রেখে, প্রিয় সমর্থকদের উচ্ছ্বাসে, উল্লাসে, প্রাপ্তির আনন্দাশ্রুতে ভাসিয়ে ৭৯তম মিনিটে মাঠ ছাড়েন আলভারেস। বদলি নামেন মার্তিনেস। বাকি সময়ে ব্যবধান আর না বাড়লেও আর্জেন্টিনার কাঙ্ক্ষিত জয়ের গল্পটা লেখা হয়ে যায় ঠিকই।আলভারেসের গল্পটা শুরু করদোবার স্থানীয় এক ফুটবল স্কুলে, হুগো রাফায়েল ভারাসের হাত ধরে। ওই ভদ্রলোক বিখ্যাত কোচ নন, মূলত পিৎজা ও রুটি বিক্রি করে বেড়াতেন, পাশাপাশি চালাতেন ছোট একটা ফুটবল স্কুল। ওই স্কুলেই আলভারেসের হাতেখড়ি। একটু একটু করে বেড়ে উঠতে লাগলেন আলভারেস। ভারাস বুঝে নিলেন প্রিয় শিষ্যটিকে আরেকটু বড় আঙিনায় ছেড়ে দেওয়ার সময় হয়েছে। আথলেতিকো কালচিন ক্লাবের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল, তাদের যুব দলে ঢুকিয়ে দিলেন। আলভারেসের সামনের আঙিনা বড় হতে থাকল।
এরপর রিভার প্লেটের যুব দলের হয়ে মূল দলে জায়গা করে নিলেন আলভারেস। গতি, দক্ষতা আর দারুণ ফিনিশিংয়ে উঠে এলেন পাদপ্রদীপের আলোয়। আর্জেন্টিনার বয়সভিত্তিক দলগুলোতে খেলে ২০২১ সালে তার অভিষেকও হয়ে গেল বিশ্বকাপ বাছাইয়ে চিলির বিপক্ষে ম্যাচে, দি মারিয়ার বদলি নেমে। আকাশি নীল-সাদা জার্সিতে গোলের খাতা খুললেন গত মার্চে একুয়েডরের বিপক্ষে ১-১ ড্র ম্যাচে। বিশ্বকাপে প্রথম গোল পেলেন বুধবার পোল্যান্ডের বিপক্ষে আর্জেন্টিনার ‘বাঁচা-মরার’ ম্যাচে।
দুই বছর আগে অদ্ভূত এক কাণ্ড করে ছেলেবেলার ফুটবল গুরু ভারাসকে চমকে দিয়েছিলেন আলভারেস। চিত্রনাট্য লিখেছিলেন আলভারেস, কুশীলব ছিলেন তার বাবা গুস্তাভো। যেটা মিলিয়ে নেওয়া যায় পোল্যান্ডের বিপক্ষে এই গোলের সঙ্গে।প্রথম ছোঁয়ায় বল পায়ে নেওয়ার মতো রেনল্ট ক্যাঙ্গো ভ্যান (গাড়ি) নিয়ে ভারাসের বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে বারবার হর্ণ বাজাতে হবে, পোল্যান্ডের ডিফেন্ডারদের মতো ভারাস তড়িঘড়ি করে ছুটে এলেও শান্ত থাকতে হবে, এরপর দুম করে শট নিয়ে গোল করার মতো গাড়ি থেকে বেরিয়ে চমকে দিতে হবে। চিত্রনাট্য মেনে তাই করেছিলেন গুস্তাভো। হর্নের শব্দে ক্ষুব্ধ ভারাসকে তেড়ে আসতে দেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে গুস্তাভো হাসিমুখে বলেছিলেন, “আলভারেস তোমার জন্য এই গাড়িটি উপহার পাঠিয়েছে, যাতে করে তুমি পণ্যগুলো সহজে ডেলিভারি দিতে পার।”বিস্ময়ে ‘থ’ পিৎজা-রুটি বিক্রেতা এবং আলভারেসের শৈশবের কোচ ভারাসের কপোল বেয়ে তখন ঝরছে আনন্দের অশ্রু।