স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ১৭ জুন: ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে দেড় বছর ধরে রাশিয়ার দখলে থাকা কয়েকটি এলাকা ‘মুক্ত’ করতে পুরোদমে অভিযান চালাচ্ছেন দেশটির সেনাবাহিনী। এই অভিযানের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের নেপথ্যে রয়েছেন গুরুত্বপূর্ণ এক ব্যক্তি। তিনি জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি।কিছুদিন আগেও ৪৯ বছর বয়সী ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান ভ্যালেরি সম্পর্কে কেউ তেমন জানতেন না। এখন জনপ্রিয়তার বিবেচনায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কিকে টেক্কা দিচ্ছেন তিনি।বন্ধু ও সহপাঠীদের কাছে ‘আমাদের ভ্যালেরা’ নামে পরিচিত জেনারেল জালুঝনিকে ২০২১ সালের জুলাইয়ে ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।জেনারেল জালুঝনির পরিচিত ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদের মতে, ব্যক্তিগতভাবে তাঁকে এই পদে নিয়োগ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট জেলনস্কি। তাঁর এই নিয়োগে অনেকে তো বটেই, জেনারেল জালুঝনি নিজেও বেশ অবাক হয়েছিলেন। কারণ, অনেককে ডিঙিয়ে তাঁকে এই পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন জেলেনস্কি।অবশ্য আগে থেকেই একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী ও আধুনিকমনা সেনা কমান্ডার হিসেবে পরিচিতি ছিল জালুঝনি। একই সঙ্গে একজন নিরহংকারী মানুষ হিসেবেও সবার কাছে তাঁর গ্রহণযোগ্যতা আছে। তিনি অধস্তনদের সঙ্গে হাসি–ঠাট্টা করতে পছন্দ করেন এবং নিজেকে অন্যদের কাছে বড় হিসেবে তুলে ধরতে চান না।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সর্বাত্মক যুদ্ধের মোকাবিলায় ইউক্রেনকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি। ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে স্পষ্ট হয়ে যায়, তিন দিনের মধ্যে রুশ সেনারা ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিতে ব্যর্থ হয়েছেন। যদিও প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হয়েছিল, তেমন কোনো বাধা ছাড়াই রাশিয়ার সেনারা কিয়েভের দখল নিয়ে নেবেন।তবে বাস্তবতা ছিল ভিন্ন। ইউক্রেনের সরকার জনগণকে এ নিয়ে আতঙ্কিত না হওয়ার আহ্বান জানান। এরপর রাশিয়ার সেনারা ইউক্রেনের উত্তর, পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে অগ্রসর হতে থাকে। একই সঙ্গে রাজধানী কিয়েভের জন্য এমন একটা হুমকি হয়ে দাঁড়ায়, যা আমলে না নেওয়ার কোনো উপায় ছিল না।জনপ্রিয়তায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির সঙ্গে টেক্কা দিচ্ছেন ভ্যালেরি জালুঝনিছবি: ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের কার্যালয়ের সৌজন্যেএরপর ইউক্রেনের নেতৃস্থানীয় কর্তাব্যক্তিদের মাথায় একটা বুদ্ধি খেলে যায়। তাঁরা পরিকল্পনা করেন, কিয়েভের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া দীর্ঘ এক নদী নিপ্রোর ওপরে থাকা সেতুগুলো ধ্বংস করে দেবেন। এতে করে হবে কী, নিপ্রো নদীর পূর্ব তীর পেরিয়ে রাশিয়ার সেনারা পশ্চিম তীরে আসতে পারবেন না। যেখানে অন্যান্য কৌশলগত স্থাপনার সঙ্গে ইউক্রেনের সরকারি কোয়ার্টারগুলোও অবস্থিত।এরপর কর্মকর্তারা বিষয়টি নিয়ে মতামত জানতে জেনারেল জালুঝনিকে ফোন করেন। ওই সময় অন্য শীর্ষ সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে একটি পরিখায় অবস্থান করছিলেন জেনারেল জালুঝনি। জানা যায়, বিষয়টি শোনার পর তাঁর উত্তর ছিল এ রকম, ‘পরিস্থিতি যা–ই হোক না কেন, আমরা এটা করব না। এটা করলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি নদীর পূর্ব তীরে থাকা আমাদের সেনাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।’এ ঘটনার পর যুদ্ধ নিয়ে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ২০২২ সালের এপ্রিলের শুরুর দিকে ইউক্রেনের সেনারা কিয়েভের উত্তর ও পূর্ব দিক থেকে রাশিয়ার সেনাদের পিছু হটতে বাধ্য করেন।সোভিয়েত আমলে ইউক্রেন যখন এর অংশ ছিল, তখন এক সেনাসদস্যের ঘরে জেনারেল ভ্যালেরির জন্ম। ভ্যালেরি এর আগে একবার বলেছিলেন, সোভিয়েত সেনাবাহিনীতে ক্ষমতাকাঠামোর বিষয়টি যে কঠোরভাবে মেনে চলা হয়, সেই অবস্থান থেকে সব সময় তিনি নিজেকে দূরে রাখতে চান।গত শতকের নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সময়ে জেনারেল ভ্যালেরি যখন সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন, তত দিনে ইউক্রেন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে।
তবে ভ্যালেরির বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইগুলো ছিল সোভিয়েত আমলের। সরাসরি অভিজ্ঞতা রয়েছে, এমন ব্যক্তিদের মাধ্যমে তিনি যুদ্ধের বাস্তবতার বিষয়গুলো প্রথম জানতে পারেন। ২০১৪ সালে তিনি পূর্ব ইউক্রেনের একটি এলাকার উপপ্রধান হিসেবে নিযুক্ত হন, যেখানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সঙ্গে ইউক্রেনের সংঘাত চলছিল। আর ওই বিচ্ছিন্নতাবাদীদের মদদ দিচ্ছিল রাশিয়ার সেনাবাহিনী।জেনারেল ভ্যালেরির কয়েকজন সহকর্মীর সঙ্গে কথা বলেছে বিবিসি। তাঁরা বলেছেন, সেনাবাহিনীতে পেশাজীবন শুরুর পর থেকেই ভ্যালেরি তাঁর অধস্তনদের সঙ্গে একটা বিশ্বস্ততার সম্পর্ক তৈরির ব্যাপারে মনোনিবেশ করেন। একই সঙ্গে ঊর্ধ্বতন হিসেবে নির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রেও তিনি এমনটাই চাইতেন।জালুঝনির উপদেষ্টা ছিলেন লিইয়ুন্ডমিলা ডোলহোসোভস্কা। রাশিয়া ইউক্রেনে হামলা করার পর শুরুর দিনগুলোতে জালুঝনির সঙ্গে ছিলেন তিনি। ডোলহোসোভস্কা বলেন, তিনি (ভ্যালেরি) তেমন একটা ঘুমাতেন না এবং যুদ্ধের ময়দানে সব সময় সেনাসদস্যদের সঙ্গে সঙ্গে থাকতেন।যুদ্ধের শুরুর দিকে কিয়েভ দখলের চেষ্টা চালাতে গিয়ে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিলেন রুশ সেনারা। কিয়েভের উপকণ্ঠে পড়ে থাকা রুশ বাহিনীর সাঁজোয়া যানফাইল ছবি: রয়টার্সযুদ্ধের শুরুর দিনগুলোতে ভ্যালেরি কী করতেন, তার বর্ণনা দিয়ে ডোলহোসোভস্কা বলেন, তিনি অন্য জেনারেলদের সঙ্গে মুঠোফোনে অনেক কথা বলতেন। তবে সব সময় নির্দিষ্ট বিষয়ে কথা বলতেন এবং শান্ত থাকতেন।
সামরিক বিশ্লেষকদের মতে, নিম্নপদস্থদের সঙ্গে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের এই বোঝাপড়ার কারণে যুদ্ধক্ষেত্রে নানা বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ইউক্রেনের জন্য অনেক সহজ হয়েছে। এতে করে ইউক্রেনীয় সেনাবাহিনী রাশিয়ার সেনাবাহিনীর চেয়ে এগিয়ে ছিল। বিশেষ সুবিধাও পেয়েছে তারা। অন্যদিকে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্ষমতার শৃঙ্খল এতটা জটিল যে, সিদ্ধান্ত গ্রহণও বেশ জটিল প্রক্রিয়া।ইউক্রেনের সামরিক বাহিনীর কিছু কিছু সূত্র তো এমনও বলছে, রাশিয়ার বিপক্ষে ইউক্রেনের যে সাফল্য, তার যৌথ কৃতিত্ব যুদ্ধক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সেনা কমান্ডারদের। জেনারেল ভ্যালেরির শুধু এতটুকুই কৃতিত্ব যে, তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে থাকা কমান্ডারদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার স্বাধীনতা দিয়েছেন।জেনারেল জালুঝনির একটাই লক্ষ্য, যেসব সমরকৌশল নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো ঠিকঠাক হচ্ছে কি না। গত গ্রীষ্মের শেষ ও শরতে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী বেশ সাফল্য পায়। এরপর দেশটির সেনারা ইউক্রেনের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকা রাশিয়ার সেনাদের কাছ থেকে দখলমুক্ত করেন।এই সাফল্যের কারণে ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান জেনারেল ভ্যালেরি জালুঝনি হয়ে ওঠেন ‘জাতীয় বীর’। যদিও প্রকাশ্যে তেমন একটা তাঁকে দেখা যায় না। আর তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন, এমন ঘটনাও বিরল। কারণ, সাক্ষাৎকার দেওয়ার ব্যাপারে তাঁকে রাজি করানো মুশকিল এক কাজ।