স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ১৭ জুন: গ্রিসের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে ভূমধ্যসাগরে ডুবে যাওয়া অভিবাসন প্রত্যাশীদের বহনকারী নৌকার আরও ৫০০ জনের মতো আরোহী এখনও নিখোঁজ বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কমিশনের দপ্তর।কমিশনের মুখপাত্র জেরেমি লরেন্স জানিয়েছেন, এই ‘ভয়ঙ্কর ঘটনায়’ নিখোঁজদের মধ্যে বিপুল সংখ্যক নারী ও শিশু রয়েছে।প্রায় ৭৫০ জন অভিবাসন প্রত্যাশীকে বহনকারী মাছ ধরার নৌকাটি বুধবার দুপুর রাত ১টার পর গ্রিসের দক্ষিণাঞ্চলীয় পাইলোস শহর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দক্ষিণপশ্চিমে ডুবে যায়। এ ঘটনায় অন্তত ৭৮ জনের মৃত্যু হয় এবং শতাধিক মানুষকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়।লরেন্স বলেছেন, ভয়াবহ প্রাণহানির এ ঘটনা মানবপাচারকারীদের বিচারের আওতায় আনার প্রয়োজনীয় জোরদার করেছে। পাশাপাশি এটাও পরিষ্কার করেছে যে সাগরে অনুসন্ধান ও উদ্ধার ‘আইনি ও মানবিকভাবে অপরিহার্য’।আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার সঙ্গে দেওয়া এক যৌথ ঘোষণায় শরণার্থী সংস্থাটি বলেছে, প্রাণহানি এড়াতে যেকোনো অনুসন্ধান ও উদ্ধারের পদক্ষেপ পরিচালনা করা দরকার।এই নৌকাডুবির ঘটনায় গ্রিসের কোস্টগার্ডের ভূমিকা কী ছিল তা নিয়ে অনুসন্ধান বেড়ে চলেছে।
গ্রিসের তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী ইয়োয়ানিস সারমাস জানিয়েছেন, কী কারণে নৌকাটি ডুবলো তা বের করতে ‘প্রকৃত অবস্থার পুঙ্খানুপুঙ্খ তদন্ত ও প্রযুক্তিগত বিশ্লেষণ’ আমলে নেওয়া হচ্ছে।প্রকাশিত ধারাবাহিক কয়েকটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গ্রিসের কোস্টগার্ডের বাঁধা একটি রশির কারণে বুধবার দুপুর রাত ২টার পর নৌকাটি ডুবে যায়। এই বিপর্যয় থেকে রক্ষা পাওয়া ১০৪ জন জীবিতের মধ্যে দুইজন বর্ণনা করেছেন কীভাবে অতিরিক্ত যাত্রী ভরা নৌকাটি এদিক ওদিক দুলছিল।গ্রিসের কোস্টগার্ড প্রথমে জানিয়েছিল, তারা নৌকাটির সঙ্গে ‘নিরাপদ দূরত্ব’ বজায় রেখেছিল। কিন্তু গ্রিসের সংবাদপত্র কাথিমেরিনি এক সূত্রের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায়, কোস্টগার্ডের সদস্যরা ওই নৌকায় দড়ি বেঁধেছিল যেন তাদের ক্রুরা এর ওপর নজর রাখতে পারে, কিন্তু নৌকায় যারা ছিল তারা তখন ইতালির দিকে যাত্রা অব্যাহত রাখার বিষয়ে একতাবদ্ধ হয়ে ওঠে।মঙ্গলবার স্থানীয় সময় রাত ১১টার দিকে এ ঘটনাটি ঘটেছিল বলে ধারণা পাওয়া গেছে। এর তিন ঘণ্টা পর নৌকাটি ডুবে যায়।
গ্রিস সরকারের মুখপাত্র ইলিয়াস সিয়াকাদারিস শুক্রবার নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, কোস্টগার্ড তাদের ‘স্থির করার জন্য, তাদের কাছে যাওয়ার জন্য, তারা সাহায্য চায় কিনা দেখার জন্য একটি দড়ি ব্যবহার করেছিল’।কিন্তু তিনি জোর দিয়ে বলেন, “সেখানে কোনো কাছির দড়ি ব্যবহার করা হয়নি।”নৌকাটিকে কাছি দিয়ে বেঁধে টেনে নিয়ে আসার বা বেঁধে এর গতি নিয়ন্ত্রণ করার কোনো চেষ্টা করা হয়নি বলে ধারণা দেন তিনি।“তারা সাহায্যের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। তারা বলে, ‘কোনো সাহায্য দরকার নেই, আমরা ইতালি যাবো’ আর তারপর তারা তাদের পথে এগিয়ে যায়,” বলেন তিনি।
অভিবাসন প্রত্যাশীদের নৌকাটিতে কোনো দড়ি বাঁধা হয়েছিল কিনা সে প্রশ্ন প্রথম তোলেন এক শরণার্থী আন্দোলনকারী। তিনি জানান নৌকাটিতে থাকা লোকজন তাকে জানিয়েছিল, তাদের আশঙ্কা এতে (দড়ি বাঁধায়) তাদের অতিরিক্ত জনাকীর্ণ নৌকাটি উল্টে যেতে পারে।কোস্টগার্ড জোর দিয়ে বলেছে, তাদের টহল জাহাজটি অল্প কয়েক মিনিটের জন্য ‘মাছ ধরার জলযানটিতে একটি ছোট দড়ি ফেলেছিল নৌকাটির ও যাত্রীদের তখনকার পরিস্থিতি দেখার জন্য।”কিন্তু নৌকাটির কিছু যাত্রী তখন উত্তরে ইতালির দিকে যাওয়ার বিষয়ে একতাবদ্ধ হয়, তখন টহল জাহাজটি ‘তাদের ওপর নজর রাখার জন্য নিরাপদ দূরত্বে সরে যায়’।ভূমধ্যসাগরের যেখানে অভিবাসন প্রত্যাশীদের বহনকারী মাছ ধরার নৌকাটি ডুবে গেছে সেখানে তল্লাশি ও উদ্ধারকাজ চলছে। কিন্তু এই দুর্ঘটনার কথা সামনের আসার পর থেকে এর সময়ক্রম ও ভাষ্যকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। কোস্টগার্ড জোর দিয়ে বলছে, ওই নৌকার ক্রুদের সঙ্গে তাদের যোগাযোগের প্রথম মুহূর্ত থেকেই সাহায্যের জন্য কোনো অনুরোধ করা হয়নি বরং তাদের বারবার সাহায্যের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাগরে অভিবাসন প্রত্যাশীদের সহযোগিতা করা্র কাজে নিয়োজিত সংস্থা ‘অ্যালার্ম ফোন’ মঙ্গলবার বিকালে গ্রিসের কোস্টগার্ড ও অন্যদের সতর্ক করে একটি ইমেইল পাঠিয়ে বলেছিল, প্রায় ৭৫০ জনের মতো আরোহী আছে এমনটি একটি নৌকা জরুরি সাহায্যের জন্য আবেদন জানাচ্ছে।জীবিতদের দুটি ভাষ্যে এমন ধারণা পাওয়া গেছে, তাদের মাছ ধরার নৌকাটিতে একটি দড়ি বাঁধার কারণে সম্ভবত সেটি ডুবে গেছে।গ্রিসের বন্দর শহর কালামাতার এক কাউন্সিলর ২৪ বছর বয়সী এক সিরীয়র সঙ্গে কথা বলার পর বলেছেন, “কোস্টগার্ডের জাহাজটি তাদের নৌকাটিকে কিছু দড়ি দিয়ে বেঁধে বাম দিকে টেনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু অজ্ঞাত কারণে নৌকাটি ডানদিকে কাত হয়ে পড়ে তারপর ডুবে যায়।”গ্রিসের সাবেক প্রধানমন্ত্রী অ্যালেক্সি সিপ্রাস বৃহস্পতিবার কালামাতা সফরে গেলে ডুবে যাওয়া নৌকাটির উদ্ধার পাওয়া আরেক যাত্রী তাকে একই ধরনের কথা জানিয়েছেন।“গ্রিসের কোস্টগার্ড তাদের অনুসরণ করতে বলেছিল, কিন্তু তারা করেননি। তখন কোস্টগার্ড তাদের দিকে একটি দড়ি ছুড়ে দেয়, কিন্তু কীভাবে দড়িটিকে টানতে হবে তা তারা জানত না, তখন নৌকাটি ডানেবামে দুলতে থাকে।“কোস্টগার্ডের জাহাজ দ্রুত গতিতে এগোতে থাকে কিন্তু ইতোমধ্যেই নৌকাটি বাম দিকে কাত হয়ে গেছে আর এভাবেই সেটি ডুবে যায়,” এক অনুবাদকের মাধ্যমে ঘটনার এ বর্ণনা শুনেছেন সিপ্রাস।গ্রিসের টেলিভিশনের খবরে বলা হয়েছে, এ ঘটনায় মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত আছে সন্দেহে বেশ কয়েকজন মিশরীয়সহ নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।