Saturday, July 27, 2024
বাড়িরাজ্যবিদ্যুৎ নিগমে সাইবার ক্রাইম, উধাও ৫০ হাজার

বিদ্যুৎ নিগমে সাইবার ক্রাইম, উধাও ৫০ হাজার

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ৫ এপ্রিল : বিদ্যুৎ বিল মিটিয়ে দেওয়ার নাম করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খালি করে দিলো সাইবার অপরাধীরা। অবাক করার বিষয় হলো বিদ্যুৎ ভোক্তাদের কনজিউমার আইডি বা কাস্টমার আইডি কি করে পেলো সাইবার অপরাধীরা। বৃহস্পতিবার দুপুরে সাইবার অপরাধের শিকার হয়ে রাজ্যের এক বরিষ্ঠ সাংবাদিক ধ্রুব রঞ্জন সেন পঞ্চাশ হাজার টাকা খোয়ালেন। বিদ্যুৎ নিগম অফিস থেকে ফোন করা হয়েছে বলে জানায় অপরাধীরা। ধ্রুব রঞ্জন সেনের কনজিউমার আইডি বা কাস্টমার আইডি নম্বর বলে দেওয়ার কারণে ধ্রুব রঞ্জন সেনের কিছুটা বিশ্বাস হয়। সাইবার অপরাধীরা তাকে জানায় তার | বিদ্যুৎ বিল আপডেট হয়নি। চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে আপডেট করা না হলে | বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হবে।

প্রথমদিকে সাইবার অপরাধীদের কথা বার্তায় সন্দেহ হয় ধ্রুব রঞ্জন সেনের। তখন গ্রাহক আইডি নম্বর জানিয়ে বিশ্বাস অর্জনের চেষ্টা করে অপরাধীরা। তারা জানায় রাজ্য বিদ্যুৎ নিগমে তারা গুজরাট থেকে এসেছে। পরক্ষণেই ধ্রুব রঞ্জন সেনের কনজিউমার আইডি ও গ্রাহক আইডি নম্বর অনর্গল বলে দেয় তারা। এতে কিছুটা বিশ্বাস জন্মায়। কিন্তু প্রশ্ন হলো কিভাবে সাইবার অপরাধীদের কাছে বিদ্যুৎ নিগমের গ্রাহক আইডি নম্বর পৌঁছালো। কি করেই বা তারা পেলো কনজিউমার আইডি। দুপুর দেড়টায় ফোন আসে। অপরাধীদের পরামর্শ অনুযায়ী ধ্রুব রঞ্জন সেন তিন টাকা গুগল পে দেওয়া মাত্র একটা ওটিপি নম্বর আসে। আর সেই নম্বরও জানিয়ে দেওয়া হয় অপরাধীদের। আধ ঘন্টার মধ্যে এসবিআই এর শ্যামলীবাজার শাখার অ্যাকাউন্ট থেকে উধাও পঞ্চাশ হাজার। সাংবাদিক ধ্রুব রঞ্জন সেন জানান, অপরাধীদের অ্যাকাউন্ট নম্বর 405502772375। নিরাজ কুশুয়া নামে সাইবার অপরাধী
358281200৯১ নম্বর ফোন থেকে ফোন করেছিল। এখন প্রশ্ন হলো ব্যাঙ্ক বা বিদ্যুৎ নিগম থেকে এভাবে গ্রাহকদের তথ্য সাইবার অপরাধীদের কাছে চলে গেলে সাধারণ মানুষ যাবেন কোথায়। গ্রাহকদের নিরাপত্তা কোথায়। সাংবাদিক ধ্রুব রঞ্জন সেন এনসিসি থানায় অভিযোগ দায়ের করেন। সাইবার অপরাধীরা প্রতিনিয়ত জাল ফেলার চেষ্টা করছে। মানুষকে বোকা বানিয়ে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট খালি করে দেওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। সাধারণ মানুষকে নানা কায়দায় তাদের জালে ফেলার চেষ্টা করছে সাইবার অপরাধীরা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সফল হচ্ছে। সাইবার অপরাধীদের ধরতে রাজ্য আরক্ষা দপ্তরে তেমন পরিকাঠামো নেই। রাজ্যে নেই কোন সাইবার অপরাধ বিশেষজ্ঞ। শুধু পুলিশ কর্মীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে এনে বিভাগটি চালানো হচ্ছে। সদ্য সমাপ্ত রাজ্য বিধানসভা অধিবেশনে যে তথ্য দেওয়া হয় তাতে দেখা গেছে ৬০ জন প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কর্মী দিয়ে চলছে এই বিভাগটি। বিজেপি শাসিত একাধিক রাজ্যে সাইবার অপরাধ ঠেকানোর জন্য তেমন কোনও পরিকাঠামোই গড়ে ওঠেনি এখনও পর্যন্ত। বছরখানেক আগে লোকসভা ও রাজ্যসভায় পেশ করা হয় হোম স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্ট। তাতেই দেশের ‘ডাবল ইঞ্জিন’ রাজ্যগুলির বেহাল দশার কথা তুলে ধরা হয়েছে। স্ট্যান্ডিং কমিটির রিপোর্ট বলছে, গুজরাট ও ত্রিপুরার মতো বিজেপি শাসিত রাজ্যে সাইবার ক্রাইম সেল মাত্র একটি। রাজ্যের পাশাপাশি উত্তর-পূর্ব ভারতেও ক্রমশ বাড়ছে
সাইবার ক্রাইমের সংখ্যা। সাইবার
ক্রাইম নিয়ে তদন্ত করার জন্য আলাদা একটি বিভাগ আছে ত্রিপুরা রাজ্যেও। কিন্তু সাইবার এক্সপার্ট বা পেশাদার তথ্যপ্রযুক্তিবিদের অভাব। কিছু পুলিশ আধিকারিকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে সাইবার ক্রাইম ঠেকানোর চেষ্টা করছে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দপ্তর। রাজ্যে কোন সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ যে নেই তা রাজ্য বিধানসভায় স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে। রাজ্য বিধানসভায় যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে দেখা গেছে, সাইবার ক্রাইম অপরাধীদের চিহ্নিতকরণের ক্ষেত্রে কল ডিটেইল রেকর্ড, ইন্টারনেট প্রোটোকল ডিটেইলস রেকর্ড এর উপর নির্ভর করতে হয়। ২০২০-২১ অর্থ বছরে রাজ্যে সাইবার ক্রাইম মামলার সংখ্যা ৪১, ২০২১-২২ অর্থ বছরে মামলা দায়ের করা হয়েছে ৩১ টি, ২০২২-২৩ অর্থ বছরে সাইবার ক্রাইম মামলা দায়ের করা হয়েছে ৪১ টি। মোট তিন বছরে ১১৩টি মামলা দায়ের করা হয়েছে বলে রাজ্য বিধানসভায় তথ্য দেওয়া হয়েছে। তবে সাইবার অপরাধ দমনে প্রয়োজন সাইবার এক্সপার্ট। তারই অভাব রয়েছে রাজ্যে। রাজ্য পুলিশের বিভিন্ন পদের অফিসারদের সাইবার সংক্রান্ত দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিয়মিত ট্রেনিং দেওয়া হয়ে থাকে বলে বিধানসভায় জানানো হয়। তবে ত্রিপুরা পুলিশ ক্রাইম ব্রাঞ্চের একটি সাইবার ক্রাইম শাখা রয়েছে যা রাজ্যস্তরে সাইবার সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধগুলি দেখাশোনা করে থাকে। এছাড়াও সাইবার সংক্রান্ত অপরাধ রোধে রাজ্যের প্রতিটি জেলায় নিজস্ব সাইবার সেল রয়েছে বলে এর আগেও বিধানসভায় জানানো হয়েছে। অস্বীকার করার উপায় নেই রাজ্যে সাইবার ক্রাইম বিশেষজ্ঞ না
থাকার কারণে অপরাধ দমনে বেগ পেতে হচ্ছে। রাজ্যের কেউ সাইবার ক্রাইমের শিকার হলে ১১২ এবং ১৫৫২৬০ এই দুটি হেল্পলাইন নম্বরে
ফোন করে অভিযোগ জানাতে পারবেন। উত্তর-পূর্ব ভারতেও ক্রমশ বাড়ছে সাইবার ক্রাইমের সংখ্যা। বিশেষ করে ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এই সংক্রান্ত অপরাধ বাড়ছে ত্রিপুরাতেও। সাধারণ মানুষ যাতে সরাসরি এই বিষয়ে অভিযোগ জানাতে পারেন এবং কী করে এর হাত থেকে বাঁচতে পারেন তার জন্য একটি বিশেষ হেল্পলাইন নম্বর চালু করা হয় রাজ্যে। প্রতিদিন রাজ্যের মানুষ সাইবার অপরাধের শিকার। কিছুদিন আগে রাজধানীর রাজবাড়ির গেইটের সামনে এক মোমো বিক্রেতার কাছ থেকে ২০০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছিলো সাইবার অপরাধীরা। বিষয়টি নিয়ে পশ্চিম থানায় অভিযোগও দায়ের করেছিলেন ওই মোমো বিক্রেতা। কিন্তু পুলিশ তেমন কোনো গুরুত্ব দেয়নি। যদিও এই ক্ষেত্রে অপরাধের ধরণ ছিলো ভিন্ন। সাইবার অপরাধীদের দৌরাত্ম্য এখন এতটাই বেড়েছে যে এবার বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ফটো এবং নাম ব্যবহার করে হোয়াটসঅ্যাপ অ্যাকাউন্ট খুলে এর মাধ্যমে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা চ্ছে। রাজ্য পুলিশের পক্ষ থেকে রাজ্যবাসীকে সতর্ক করা হলেও অপরাধ প্রবনতা কিন্তু কমছে না। একটি সাইবার র‍্যাকেট বা গ্যাং, জালিয়াতি করে অনেকের কাছ থেকেই টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। দেশের বিভিন্ন এলাকার মতই এই ধরণের ঘটনা বাড়ছে রাজ্যেও। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সাফল্য আছে, তবে তা সিন্ধুতে বিন্দু সম। দেশের আরও অনেক রাজ্যের মতই এই ধরণের ঘটনার সঙ্গে যুক্ত কয়েকজন রাজ্যে ধরা পড়লেও এই ধরনের অপরাধ বা টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ঘটনা বন্ধ হয়নি। শুধুমাত্র টাকা হাতিয়ে
নেওয়াই নয়, বাড়ছে আরও অনেক অপরাধও। ২০১৭ থেকে ২০২৩ এই ছয় বছরে দেশে নথিভুক্ত সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত মামলা ক্রমশ বেড়েছে। তা উল্লেখ করে রীতিমতো উদ্বেগ প্রকাশ করে হোম স্ট্যান্ডিং কমিটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কাছে একগুচ্ছ সুপারিশ করেছে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য দেশের সমস্ত রাজ্যে জেলাভিত্তিক সাইবার সেল গড়ে তুলতে হবে। বিষয়টি এতখানি গুরুত্বপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও গোয়া, অসমে একটিও সাইবার ক্রাইম সেল নেই। উত্তরপ্রদেশের মতো বড় রাজ্যে সাইবার সেলের সংখ্যা মাত্র দুটি। আরও সুপারিশ করা হয়েছে, প্রতিটি রাজ্যকে সাইবার ক্রাইমের ম্যাপ তৈরি করে “হট স্পট” চিহ্নিত করতে হবে। এতে অপরাধের দ্রুত কিনারা করা সম্ভব হবে। তাছাড়া, স্ট্যান্ডিং কমিটি বর্তমান সাইবার সেলগুলিকে ডার্ক ওয়েব মনিটরিং সেলে উন্নীত করতে বলেছে। সোশ্যাল মিডিয়া মনিটরিং সেলের সংখ্যা আরও বাড়াতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। ওই কমিটির আরও প্রস্তাব, সাইবার ক্রাইমের মোকাবিলায় পুলিশ কর্মী নিয়োগের পাশাপাশি রাজ্যগুলিকে সাইবার এক্সপার্ট পেশাদার তথ্য-প্রযুক্তিবিদ নিয়োগে উৎসাহ দিক স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। আন্তঃরাজ্য সাইবার ক্রাইমের তদন্তে ভিন রাজ্যে যাওয়া তদন্তকারী অফিসারদের সংশ্লিষ্ট রাজ্য যাতে সব ধরনের সাহায্য করে, সেই ব্যবস্থা করতে হবে বলে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে রিপোর্টে। কিন্তু পরামর্শ মেনে রাজ্যগুলোতে কি সাইবার অপরাধ দমনে পরিকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। করা হয়নি। আর এর খেসারত দিচ্ছে সাধারণ মানুষ।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য