Friday, April 19, 2024
বাড়িখেলামেসির প্রাপ্তির ছবিতে ‘শূন্যতার’ আচঁড়

মেসির প্রাপ্তির ছবিতে ‘শূন্যতার’ আচঁড়

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ১৯ ডিসেম্বর: যখন ঘোষণা এলো, ‘এল কাপিতানো।’ শুরু থেকে গুমগুম করতে থাকা লুসাইলের গ্যালারি ‘মেসি, মেসি’ গগনবিদারী চিৎকারে যেন গর্জে উঠল। লিওনেল মেসি এলেন। সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার নিলেন। পাশে থাকা ট্রফিতে চুমু আঁকলেন। এর আগেও তিনি ভুরিভুরি ট্রফিতে চুমু এঁকেছেন, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছিল এটা সম্পূর্ণ আলাদা।এরপর যখন ট্রফি নিতে এলেন, কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানি তাকে পরিয়ে দিলেন মধ্যপ্রাচ্যের রাজকীয় পোষাক। আমিরের বেশ পেয়ে হাসলেন মেসি কিন্তু দুই হাতের তালু ঘষতে লাগলেন। অধরা বিশ্বকাপ দুহাতে জড়িয়ে ধরতে, উঁচিয়ে ধরতে যে তর সইছে না তার।এই ট্রফিটির জন্য ‘অনন্তকাল’ ধরে মেসি অপেক্ষার দিন গুণেছেন। ২০১৪ সালে খুব কাছে এসেও না পাওয়ার হৃদয়ভাঙা বেদনায় কেঁদেছেন। ক্যারিয়ারের পড়ন্ত বিকেলে হলেও তিনি হাসলেন। অবশেষে সাফল্যের রং-তুলিতে লিখলেন অবিস্মরণীয় গল্প।

এর আগেও বিশ্বকাপের আঙিনায় পা রেখেছিলেন চারবার। এরমধ্যে ২০১৪ সালের ব্রাজিল বিশ্বকাপের সময় ছিলেন তুঙ্গস্পর্শী ফর্মে। মারাকানার ফাইনালে গিয়েও পারেননি। ২০১৮ সালেও ছিলেন দারুণ ছন্দে। কিন্তু আলবিসেলেস্তেদের চাওয়া-পাওয়ার ভরকেন্দ্রে থাকার ভার বইতে পারেননি। আর্জেন্টিনার সঙ্গে পথচলাও থেমেছিল শেষ ষোলোয়।রাশিয়ার আসরের পর জাতীয় দলকে বিদায়ও বলে দিয়েছিলেন। ২৫০ দিনের বিচ্ছেদের অবসান ঘটিয়ে ফিরলেন। দলের হাল ধরলেন। সবকিছু নতুন করে শুরু করেছিলেন বলেই মরুভুমিতে এসে পেলেন মুঠোভরে।এবার তিনি শুধু জাদুকর নন, নেতাও হয়ে উঠলেন। ৩৬ বছর ধরে বৈশ্বিক ফুটবলের সর্বোচ্চ আঙিনায় ধুঁকতে থাকা আর্জেন্টিনাকে পথ দেখালেন কঠিন কাপ্তানের মতো। ঝঞ্জা-বিক্ষুব্ধ পথে, প্রতিকূল স্রোতে শক্ত হাতে হাল ধরে রাখলেন। প্রশস্ত ডানায় সতীর্থদের ছায়া দিলেন, অবিশ্বাস্য দৃঢ়তায় প্রতিটি বাঁক পেরিয়ে আর্জেন্টিনাকেও পৌঁছে দিলেন কাঙিক্ষত বন্দরে।

সৌদি আরবের বিপক্ষে এগিয়ে গিয়েও ২-১ গোলের হার বড় ধাক্কা হয়ে আসে আর্জেন্টিনার জন্য। ওই হার যেন টানা ৩৬ ম্যাচ অপরাজিত থাকার টগবগে আত্মবিশ্বাস নিয়ে আসা আলবিসেলেস্তেদেরকে মুদ্রার উল্টোপিঠ দেখিয়ে দেয়। কৌশলী কোচ লিওনেল স্কালোনি বুঝে নেন বাকিটা। মেসিও বুঝে নেন শুধু গোল করা যথেষ্ঠ নয় তার জন্য।গ্রুপ ও নকআউট পর্বের পরের পথচলায় তাই মেসি কেবল নিজে গোলের ফুল ফুটিয়ে সামনে থেকে নেতৃত্ব দেন, আক্রমণের সুর বেঁধে দিয়ে সতীর্থদের গোলের আনন্দে ডানা মেলার মঞ্চ তৈরি করে দেন। এবারের আসর তিনি শেষ করেছেন ৭ গোল করে, অ্যাসিস্টের সংখ্যা তিনটি।নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে ম্যাচে মেসির নেতৃত্বের আরেক রূপের দেখা মেলে। তিনি বিনয়ী, নম্র। মেজাজ হারানো সতীর্থদের শান্ত করতে বেশি দেখা যায় তাকে। নিজে মেজাজ হারান কালেভদ্রে, কিন্তু ডাচদের বিপক্ষে কোয়ার্টার-ফাইনালে সেই তিনিই মেজাজ হারান দফায় দফায়।

জয়ের পর বুনো উল্লাসে মেতে ক্ষান্ত হন না, ভট ভেহর্স্টকে ‘বোকা’ বলতেও বাঁধে না তার! ভুল-ঠিক যাই হোক, নেতার কাজ দলকে আগলে রাখা। তিনিও তাই আনহেল দি মারিয়া, হুয়ান রিকুয়েমেদের হয়ে ফন খালকে এক হাত নিয়ে নেন! মেসিকে এর আগে এমন রূপে দেখা গেছে কবে?সেমি-ফাইনালে ক্রোয়েশিয়াকে ৩-০ গোলে গুঁড়িয়ে দেওয়ার পর তিনি হুট করেই দিলেন ঘোষণা। এতদিনের গুঞ্জনের ইতি টেনে দিতে বললেন- বিশ্বকাপে এবারই শেষ। পাদপ্রদীপের আলো থেকে সরে যেতে চায় না কেউ, কিন্তু তিনি চাইলেন। বিষাদের রাগিনী বাজিয়ে দিয়ে দলকে যেন বার্তাও দিয়ে দিলেন-এবার রাঙাও মোরে।ফাইনালের চিত্রনাট্য ৮০ মিনিট পর্যন্ত রঙিন ছিল আর্জেন্টিনার জন্য। আনহেল দি মারিয়ার আদায় করে নেওয়া পেনাল্টি থেকে গোল করে এগিয়ে দলকে এগিয়ে নিলেন মেসি। প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের এক আসরে গ্রুপ পর্ব, শেষ ষোলো, কোয়ার্টার-ফাইনাল, সেমি-ফাইনাল ও ফাইনালে গোল করার কীর্তি গড়লেন এই জাদুকর।পরে ব্যবধান দ্বিগুণ করলেন দি মারিয়া। এই আক্রমণের উৎসমূলে মেসি। মাঝমাঠ থেকে জাদুকরী এক টোকায় পাস দেন ডান দিকে, বল ধরে হুলিয়ান আলভারেস এগিয়ে গিয়ে সামনে বাড়ান আলেক্সিস মাক আলিস্তেরকে। তার পাস বক্সে বাঁ দিকে ফাঁকায় পেয়ে কোনাকুনি শট নেন দি মারিয়া। ঝাঁপিয়ে পড়া উগো লরিসকে ফাঁকি দিয়ে বল খুঁজে নেয় ঠিকানা। টানা দ্বিতীয় শিরোপা জয়ের স্বপ্ন নিয়ে নামা ফ্রান্সের হাঁসফাঁস অবস্থা।

ঝানু ট্যাকটিশিয়ান দিদিয়ের দেশম পাশার দান বদলালেন। অলিভিয়ে জিরুদ ও উসমান দেম্বেলেকে তুলে নামালেন রান্দাল কোলো মুয়ানি ও মারকাস থুরামকে। ছায়া হয়ে থাকা কিলিয়ান এমবাপে ফিরে পেলেন দুর্বার গতি। ৯০ সেকেন্ডের ব্যবধানে জোড়া গোল করে ওলট-পালট করে দিলেন সবকিছু! কিন্তু খুব কাছে এসে সব হারানোর শঙ্কার প্রবল ঝুঁকির মধ্যেও শান্ত মেসি।নির্ধারিত সময়ে ম্যাচ শেষ করে দেওয়ার সুযোগ মেসি, আলভারেসরা পেয়েছিলেন কয়েকবার, কিন্তু পায়ে কাজে লাগাতে পারেননি। তাতে ম্যাচ গড়ায় অতিরিক্ত সময়ে। অপেক্ষা বাড়ে আর্জেন্টিনার। মেসিরও।১০৮তম মিনিটে আবারও ঝলক দেখান মেসি। ডান দিক থেকে মার্তিনেসের বুলেট গতির কোনাকুনি শট কোনোমতে ফেরান লরিস, তবে বল গ্লাভসে জমাতে পারেননি। গোলমুখে পাওয়া বল সুযোগসন্ধানী টোকায় জালে জড়িয়ে দেন মেসি। এবার অবশ্য জাদুকরী বাঁ পায়ের টোকায় নয়, সামর্থ্য দেখান ডান পায়ের।তখনও বাকি রুদ্ধশ্বাস নাটকীয়তার। মহানায়ককে নিয়ে লেখা মহাকাব্যের পাতায় পাতায় উত্থান-পতনের, টানাপোড়েনের ছড়াছড়ি না থাকলে কীভাবে হয়? তাই তো বক্সে গনসালে মনতিয়েলের হাতে বল লাগে। এমবাপে হ্যাটট্রিক পূরণ করলে আর্জেন্টিনার আকাশ থেকে জয়ের ঘ্রাণ উড়ে যায় নিমিষে। ম্যাচের ভাগ্য টাইব্রেকারে গড়ানোয় ফের দুলতে থাকে মেসির রাজ্যপাঠও।

এমবাপের প্রথম শটে আবারও পরাস্ত মার্তিনেস। পুরো ম্যাচে এ নিয়ে চতুর্থবার! মেসিও জালের দেখা পেলেন প্রথম শটে। যেন বিশ্বকাপের আঙিনায় নিজের শেষ কাজটুকু করে বাকিটা ছেড়ে দিলেন সতীর্থদের উপর।এবার শুরু বাকিদের প্রতিদান দেওয়ার পালা। কিংসলে কোমানের শট প্রজাপতির ডানায় ভর করে উড়ে গিয়ে আটকালেন মার্তিনেস। টুর্নামেন্টে তেমন একটা সুযোগ না পাওয়া পাওলো দিবালা লক্ষ্যভেদ করে বাড়ালেন ব্যবধান। অহেলিয়া চুয়ামেনির শট পোস্টের বাইরে গেলে ফ্রান্স দিশেহারা। এরপর লেয়ান্দ্রো পারেদেস এবং মনতিয়েলের গোলে উড়ল মেসির আর্জেন্টিনা। হ্যান্ডবলের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত দারুণভাবে করলেন মনতিয়েল। তার ঠাণ্ডর মাথার গোলের জন্যই আর আর্জেন্টিনার পঞ্চম শট নেওয়ার দরকার পড়েনি।

এরপর এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দৃশ্য। বিশ্বকাপ ট্রফি নিয়ে সতীর্থদের কাঁধে মেসি। ঠিক এমন ছবিই কিক অফের আগে জায়ান্ট স্ক্রিনে ভেসে উঠেছিল। ৩৬ বছর আগের সেই ছবিতে ভালদানো-বুরুচাগাদের কাঁধে ছিলেন মারাদোনা। নতুন ছবিতে মার্তিনেস-দিবালাদের কাঁধে মেসি, যে জাদুকরকে আর হয়তো দেখা যাবে না বিশ্বকাপের আঙিনায়। প্রাপ্তির ছবিতে শূন্যতার আচঁড়ও দিয়ে গেলেন ‘কাপিতানো’ মেসি!কোচ লিওনেল স্কালোনি বলেছেন, ২০২৬ আসরে মেসির জন্য তোলা থাকবে ১০ নম্বর জার্সি। তবে এরপরও হয়তো শিরোপা ধরে রাখার অভিযানে এই মহানায়ককে ছাড়াই হয়তো নামতে হতে পারে ফের্নান্দেস-আলভারেস-মাক আলিস্তেরদের।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য