স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ১৯ অক্টোবর: গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইয়াহিয়া সিনওয়ার হত্যাকেই এখন পর্যন্ত ইসরাইলের ‘সবচেয়ে বড় বিজয়’ হিসেবে দেখা হচ্ছে।বিবিসি লিখেছে, তার মৃত্যু হামাসের জন্য গুরুতর আঘাত। ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী সংগঠনটিকে তিনিই লড়াকু বাহিনীতে পরিণত করেছিলেন, যা ইসরায়েল রাষ্ট্রকে তার ইতিহাসে সবচেয়ে বড় পরাজয়ের মুখে ফেলেছিল।বিশেষ বাহিনীর পরিকল্পিত অভিযানে সিনওয়ার মারা যাননি, বরং দক্ষিণ গাজার রাফায় ইসরায়েলি বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে প্রাণ হারিয়েছেন তিনি।ঘটনাস্থল থেকে তোলা একটি ছবিতে দেখা যায়, ট্যাংকের গোলার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত একটি ভবনের ধ্বংসস্তূপের মধ্যে মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন সিনওয়ার, যিনি যুদ্ধের পোশাক পরিহিত।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সেনাদের প্রশংসা করে বলেছেন, এ বিজয় বড় হলেও এখানেই যুদ্ধ শেষ নয়।তিনি বলেন, “যারা আমাদের ক্ষতি করে তাদের কী হয়, আজ আমরা আবারও স্পষ্ট করলাম। আজ আমরা আরও একবার বিশ্বকে দেখিয়েছি যে মন্দের উপরে ভালোর জয় আছে।“কিন্তু প্রিয়জনরা, যুদ্ধ এখনও শেষ হয়নি। এটা কঠিন এবং এর জন্য আমাদের চরম মূল্য দিতে হচ্ছে।”আমাদের সামনে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ অপেক্ষা করছে। আমাদের ধৈর্য, একতা, সাহস এবং দৃঢ়তার প্রয়োজন। আমরা একসঙ্গে লড়াই করব এবং ঈশ্বরের কৃপায় আমরা একসঙ্গে জয়ী হব।”বিবিসি লিখেছে, নেতানিয়াহু এবং গাজা যুদ্ধে সমর্থনকারী ইসরায়েলিরা বিজয়ের জন্য মুখিয়ে আছেন। সামরিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে হামাসকে ধ্বংস করা এবং জিম্মিদের ঘরে ফিরিয়ে আনাই যে যুদ্ধের লক্ষ্য, তা বহুবার বলেছেন ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী।
এর কোনোটিই এখনও অর্জিত হয়নি, যদিও এক বছরের যুদ্ধে কমপক্ষে ৪২ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে এবং গাজার বেশিরভাগ অংশ ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।কিন্তু হামাসের হাতে জিম্মি সবাই মুক্ত হয়নি। হামাস লড়াই করছে এবং কখনও কখনও ইসরায়েলি সেনাদের হত্যা করছে।এ পরিস্থিতিতে সিনওয়ারকে হত্যা ছিল ইসরায়েলের বড় লক্ষ্য। তবে যতক্ষণ না নেতানিয়াহু দাবি করবেন যে যুদ্ধের অন্যান্য লক্ষ্য অর্জিত হয়েছে, ততক্ষণ যুদ্ধ চলবে।ইয়াহিয়া সিনওয়ার ১৯৬২ সালে গাজার খান ইউনিসের একটি শরণার্থী শিবিরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালের মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধে মিশরের কাছ থেকে ইসরায়েল যখন গাজার দখল নেয়, তখন তার বয়স ছিল পাঁচ বছর।১৯৪৮ সালে প্রথম আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের মাধ্যমে ইহুদি রাষ্ট্র ইসরায়েলের জন্ম হয়। যুদ্ধে জয়ী ইসরায়েল অধিকৃত অঞ্চল থেকে ৭ লাখের বেশি পরিবারকে বাস্তুচ্যুত করেছিল, যার একটি সিনওয়ারের পরিবার।
উত্তর গাজা সীমান্তের যে শহর এখন আশকেলন নামে পরিচিত, সেখান থেকে তার পরিবার শরণার্থী শিবিরে গিয়েছিল।সিনওয়ারের বয়স যখন ২০ বছর, তখন চার তথ্যদাতাকে হত্যার দায়ে তাকে দোষী সাব্যস্ত করে ইসরায়েল। ২২ বছর কারাগারে থাকাকালে তিনি হিব্রু ভাষা শেখেন, পড়াশোনা করেন শত্রুদের নিয়ে এবং কীভাবে তাদের সঙ্গে লড়াই করতে হবে তা নিয়েই তিনি কাজ করছিলেন।কারাগারে থাকার সময় ইসরায়েলের কাছে তার দাঁতের রেকর্ড এবং তার ডিএনএর একটি নমুনা নেওয়া হয়েছিল, যা দিয়ে তারা দেহ শনাক্ত করা যেতে পারে।২০১১ সালে গিলাদ শালিত নামের এক ইসরায়েলি সৈনিকের বিনিময়ে যে সহ্রসাধিক ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল, তাদের একজন ছিলেন সিনওয়ার।
গত বছরের ৭ অক্টোবর সিনওয়ার ও তার সঙ্গীরা সুপরিকল্পিত ধারাবাহিক আক্রমণে ইসরাইলকে সবচেয়ে ভয়াবহ পরাজয়ের মুখে ফেলে। ওই মানসিক আঘাত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে ইসরায়েলিরা।বিবিসি লিখেছে, প্রায় ১,২০০ ইসরায়েলিকে হত্যা, জিম্মি করা এবং হামাসের উদযাপন অনেক ইসরায়েলিকে নাৎসি গণহত্যার কথা কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।বন্দি বিনিময়ের নিজের অভিজ্ঞতা থেকে সিনওয়ার জিম্মি করার মূল্য ও শক্তি সম্পর্কে ভালো ধারণা পেয়েছিলেন।গাজায় তেল আবিবের যে ১০১ জন জিম্মি আছে, তার অর্ধেক ইতোমধ্যে মারা যেতে পারে বলে ধারণা করছে ইসরায়েল। হামলার বার্ষিকীতে স্বজনরা সমাবেশ করে জিম্মিদের ফেরাতে নতুন আলোচনার জন্য ইসরায়েল সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছিল।
জিম্মি মাতান জাঙ্গাউকারের মা আইনাভ জাঙ্গাউকার তার দেশের প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে বলেছিলেন, “নেতানিয়াহু, জিম্মিদের কবর দেবেন না। এখনই মধ্যস্থতাকারী ও জনগণের কাছে যান এবং ইসরায়েলি নতুন উদ্যোগ তুলে ধরুন।”আমার মাতান এবং টানেলে থাকা বাকি জিম্মিদের জন্য সময় ফুরিয়ে গেছে। বিজয়ের ছবি তো আছেই। এখন একটি চুক্তি করুন!”আইনাভ জাঙ্গাউকার বলেছিলেন, “নেতানিয়াহু যদি এই মুহূর্তকে কাজ না লাগান এবং খরুচে এ যুদ্ধ শেষ করার ইসরায়েলি নতুন উদ্যোগ না নেন, এর অর্থ হচ্ছে তিনি যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে এবং তার শাসনকে শক্তিশালী করতে জিম্মিদের আশা ছেড়ে দিয়েছেন।”বিবিসি লিখেছে, অনেক ইসরায়েলি বিশ্বাস করেন যে, নেতানিয়াহু গাজা যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করতে চান, যাতে সিনওয়ার ও তার সহযোদ্ধাদের হামলার বিষয়ে নিরাপত্তা ব্যর্থতার জন্য প্রশ্ন না ওঠে এবং গুরুতর দুর্নীতির অভিযোগে নেতানিয়াহুর বিরুদ্ধে বিচারকাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত থাকে।এসব অভিযোগ অস্বীকার করে নেতানিয়াহু জোর দিয়ে বলে আসছেন, গাজায় হামাসের বিরুদ্ধে ‘পূর্ণাঙ্গ বিজয়’ হলেই কেবল ইসরায়েলের নিরাপত্তা ফিরে আসবে।
অন্যান্য সংবাদমাধ্যমের মত বিবিসিকেও গাজায় ঢুকতে দেয় না ইসরায়েল; কেবল সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বিরল একটি-দুটি সফর ছাড়া।সিনওয়ারের জন্মস্থান খান ইউনিসের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে স্থানীয় বিশ্বস্ত ফ্রিল্যান্সারদের মাধ্যমে বিবিসি কথা বলেছে ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে। তারা বলছেন, যুদ্ধ চলবে।ড. রামাদান ফারিস বলেন, “এই যুদ্ধ সিনওয়ার, হানিয়া বা মিশাল বা কোনো নেতা বা কর্মকর্তার ওপর নির্ভরশীল নয়।“ফিলিস্তিনি জনগণকে নির্মূলে যে এ যুদ্ধ চালানো হচ্ছে তা আমরা সবাই জানি এবং বুঝি। বিষয়টি সিনওয়ার বা অন্য কারও চেয়ে অনেক বড়।”
আদনান আশোর বলেন, সিনওয়ারের মৃত্যুতে কেউ কেউ দুঃখ পেয়েছেন, আবার কেউ তার ব্যাপারে উদাসীন।”তারা শুধু আমাদের পেছনে লাগেনি। তারা পুরো মধ্যপ্রাচ্যকে চায়। তারা লেবানন, সিরিয়া ও ইয়েমেনেও লড়াই করছে। ১৯১৯ সাল থেকে ১০০ বছরেরও বেশি সময় ধরে আমাদের ও ইহুদিদের মধ্যে এই যুদ্ধ চলছে।”তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, সিনওয়ারের মৃত্যু হামাসকে প্রভাবিত করবে কি না।জবাবে আদনান আশোর বলেন, “আশা করি না, ইনশাআল্লাহ। আমাকে ব্যাখ্যা করতে দিন: হামাস কেবল সিনওয়ার নয়… এটা একটা জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রশ্ন।”
বিবিসি লিখেছে, গাজায় যুদ্ধ চলছে। গাজার উত্তরাঞ্চলে এক হামলায় ২৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইসরায়েল দাবি করেছে, তারা হামাসের একটি কমান্ড সেন্টারে হামলা চালিয়েছে। স্থানীয় হাসপাতালের চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, ওই ঘটনায় তারা যেসব আহতকে চিকিৎসা দিয়েছেন, তারা বেসামরিক নাগরিক।আমেরিকানরা আরও খাদ্য ও ত্রাণ সরবরাহের অনুমতি দিতে ইসরায়েলকে ধমক দেওয়ার পর ত্রাণের প্যারাশুট গাজায় ঢুকতে শুরু করেছে।১৯৯০-এর দশক থেকে হামাসের প্রত্যেক নেতাকে ইসরাইল হত্যা করেছে, কিন্তু সবসময়ই একজন উত্তরসূরি ছিল। ইজরায়েল যখন সিনওয়ার হত্যা উদযাপন করছে, তখনও হামাসের হাতে জিম্মি রয়েছে অনেক ইহুদি; মুক্তিকামী সংগঠনটি লড়াইও জারি রেখেছে।