Wednesday, May 21, 2025
বাড়িবিশ্ব সংবাদ‘মনে হচ্ছিল, কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে’

‘মনে হচ্ছিল, কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে’

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক,৭ ফেব্রুয়ারি: সোমবার ভোররাতে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে মেলিসা সালমানের ঘুম যখন ভাঙে, তিনি ভেবেছিলেন ‘কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে’।ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় বসবাস করার কারণে তিনি বাড়ি-ঘরে ঝাঁকুনিতে অভ্যস্ত। তবে এদিনটা ছিল অন্যরকম।তুরস্কের কাহরামানমারাস প্রদেশের বাসিন্দা মেলিসা বিবিসিকে বলেন, “আজ যা হয়েছে, তেমন অভিজ্ঞতা আমাদের জীবনে প্রথম। আমরা ভেবেছিলাম কেয়ামত শুরু হয়ে গেছে।”সোমবার স্থানীয় সময় ভোর ৪টা ১৭ মিনিটে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে কেঁপে উঠে তুরস্ক, সিরিয়া, লেবানন, ইসরায়েল, ফিলিস্তিন ও সাইপ্রাস।ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল সিরিয়া সীমান্তবর্তী তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলীয় শহর গাজিয়ানতেপের কাছে ভূপৃষ্ঠের প্রায় ১৮ কিলোমিটার গভীরে। প্রায় দুই মিনিট ধরে প্রচণ্ড কম্পন অনুভূত হয় বলে জানিয়েছেন দুর্গত এলাকার বাসিন্দারা।

৮৪ বছরের মধ্যে এটাকে তুরস্কের সবচেয়ে ভয়াবহ দুর্যোগ বলে বর্ণনা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট রিসেপ তায়েপ এরদোয়ান। ১৯৩৯ সালে তুরস্কের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের এরজিনকানে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার ভূমিকম্প ৩০ হাজারের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল।যুক্তরাষ্ট্রের জিওলোজিক্যাল সার্ভের রেকর্ড অনুযায়ী, ২০২১ সালের অগাস্টের পর বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ভূমিকম্প ছিল এটি।ভূমিকম্পে তুরস্ক ও সিরিয়া মিলিয়ে ২ হাজার সাতশর বেশি মানুষের মৃত্যুর খবর দিয়েছে সিএনএন।তুরস্কের ভাইস প্রেসিডেন্ট ফুয়াত ওকতাই জানান, ভূমিকম্পে তার দেশে এখন পর্যন্ত এক হাজার ৫৪১ জনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত হওয়া গেছে। আহত হয়েছেন প্রায় ১০ হাজার মানুষ। ধসে পড়েছে সাড়ে ৩ হাজার ভবন।সিরিয়া সরকার এবং বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকায় উদ্ধার অভিযান পরিচালনা করা সংস্থার দেওয়া তথ্যানুযায়ী, সে দেশে এখন পর্যন্ত ৯২৮ জন মারা গেছেন। দেড় হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন।

দুই দেশেই এখনও উদ্ধার অভিযান চলছে। তাই স্বাভাবিকভাবেই হতাহতের সংখ্যা বাড়বে।এদিকে, আগামী কয়েকদিনে বৈরী আবহাওয়ায় উদ্ধার কাজ ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।বিবিসি ওয়েদার বলছে, তুরস্কের ভূমিকম্প দুর্গত এলাকায় আগামী কয়েক দিনে ভারি বৃষ্টি ও তুষারপাত হতে পারে। সেখানে দিনের বেলা তাপমাত্রা ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস থাকবে এবং রাতের বেলায় তা আরও কমে যেতে পারে।এছাড়া ওই এলাকা ৩ থেকে ৫ সেন্টিমিটার গভীর তুষারে ঢেকে যেতে পারে। তুরস্কের উত্তরের পাহাড়ি এলাকায় আরও বেশি তুষারপাতের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। পাহাড়ে ৫০ থেকে ১০০ সেন্টিমিটার পর্যন্ত তুষারপাত হতে পারে।

প্রথম ভূমিকম্পের প্রায় ১২ ঘণ্টা পর স্থানীয় সময় দুপুরের দিকে তুরস্কে দ্বিতীয় আরেকটি ভূমিকম্প হয়। রিখটার স্কেলে যেটির মাত্রা ছিল ৭ দশমিক ৭। এটির উৎপত্তিস্থল ছিল কাহরামানমারাস প্রদেশের এলবিস্তান জেলা।দ্বিতীয় ভূমিকম্পটি ভোরের ভূমিকম্পের পরাঘাত ভাবা হলেও এটি তা ছিল না বলে মনে করছে তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ। এক কর্মকর্তা বিবিসিকে বলেন, “দ্বিতীয়টি আলাদা নতুন আরেকটি ভূমিকম্প।”বিশ্বের সবচেয়ে ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকায় তুরস্কের অবস্থান। যে অঞ্চলটিকে বলা হয় পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্ট। তুরস্কের দক্ষিণ-পূর্ব সীমান্তের দক্ষিণ পশ্চিম থেকে উত্তর-পশ্চিম বরাবর এই ফল্টের অবস্থান।ভূমিকম্প হওয়ার জন্য ফল্ট লাইন বা চ্যুতি রেখা বড় ভূমিকা রাখে। ভূমিকম্পবিদরা তুরস্কের ওই পূর্ব আনাতোলিয়ান ফল্টকে অনেক আগেই ‘খুব বিপজ্জনক’ বলে সতর্ক করেছেন।

এদিন ভূমিকম্পে তুরস্কে যে সাড়ে ৩ হাজার ভবন ধসে পড়েছে, সেগুলোর মধ্যে গাজিয়ানতেপ দুর্গও রয়েছে। ঐতিহাসিক এই দুর্গটি দুই হাজার বছরের বেশি পুরনো।দেশটিতে যেসব ভবন ধসে পড়েছে তার অনেকগুলোই চার বা পাঁচ তলা। দিয়ারবাকির শহরে একটি শপিংমল ধসে পড়েছে।সোমবার ভোরের ভূমিকম্পের সময়ের বেশ কিছু ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। যেখানে দেখা যায়, ভবনের ধ্বংসস্তূপ সড়কে ছড়িয়ে আছে। যেদিকে চোখ যায় শুধু ধ্বংসস্তূপ।ভূমিকম্পে তুরস্কের জ্বালানি অবকাঠামো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলেও জানায় বিবিসি। সোশাল মিডিয়ায় আসা একাধিক ভিডিওতে দেশটির দক্ষিণে কোথাও আগুন জ্বলতে দেখা যায়। অনেকে দাবি করেছেন, গ্যাস পাইপলাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে ওই আগুন লেগেছে।

তুরস্কের জ্বালানিমন্ত্রী ফাতিহ দনমেজও গ্যাসক্ষেত্রে গুরুতর ক্ষতি হওয়ার খবর নিশ্চিত করেছেন। তবে সেখানে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে কি না, তা জানাননি।ভূমিকম্পের পর ‘তার্কিস রেড ক্রিসেন্ট’র পক্ষ থেকে নাগরিকদের রক্তদান করতে আহ্বান জানানো হয়।এখন পর্যন্ত ৪৫টি দেশ থেকে তুরস্ককে সহায়তার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরদোয়ান।ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে তুরস্কে তল্লাশি ও উদ্ধার অভিযান চালাতে উদ্ধারকর্মীদের কয়েকটি দল পাঠানো হচ্ছে। নেদারল্যান্ডস ও রোমানিয়া থেকে উদ্ধারকর্মীদের দল এরইমধ্যে তুরস্কে রওনা হয়ে গেছে।যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি, ইসরায়েল থেকে সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছে।

রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিজে বার্তা পাঠিয়ে এরদোয়ান ও সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল আসাদকে সব ধরনের সহায়তার প্রস্তাব দিয়েছেন।তুরস্কের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুলেইমন সইলু বলেন, ভূমিকম্পে দেশটির ১০টি নগরী বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সেগুলো হলো: গাজিয়ানতেপ, দিয়ারবাকির, হাতাই, ওসমানিয়ে, আদিয়ামান, মালাতিয়া, সানলিউরফা, আদানা ও কিলিস।ওইসব নগরীতে অন্তত এক সপ্তাহের জন্য স্কুল বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে।তুরস্কের চেয়ে সিরিয়াও ভূমিকম্পে দুর্গতদের কষ্টের মাত্রা বেশি। কারণ দীর্ঘ ১১ বছরের গৃহযুদ্ধে দেশটিতে আগে থেকেই লাখ লাখ মানুষ গৃহহীন হয়ে বিভিন্ন ক্যাম্পে বসবাস করছেন।দেশটির উত্তর-পশ্চিমের বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোতে হোয়াইট হেলমেট গ্রুপ উদ্ধার কাজ পরিচালনা করছে।

চোখের পানি আটকে হোয়াইট হেলমেটের একজন স্বেচ্ছাসেবক বিবিসিকে তুরস্ক সীমান্তবর্তী বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত শহর সারমাদার বর্ণনা দেন।তিনি বলেন, ‘‘ভূমিকম্পে উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ার বিভিন্ন শহরে ও গ্রামে অনেক ভবস ধসে পড়েছে। এখনও অনেক মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছেন। আমরা তাদের বাঁচাতে চেষ্টা করছি। কিন্তু কাজটা আমাদের জন্য ভীষণ কঠিন। আমাদের সহায়তা প্রয়োজন।”সোমবার ভোরের ভূমিকম্পটি এতটাই শক্তিশালী ছিল যে সেটা সাইপ্রাস, লেবানন এবং ইসরায়েল থেকেও ভালোভাবেই টের পাওয়া গেছে।লেবাননের বৈরুতের বাসিন্দা এক শিক্ষার্থী বিবিসিকে বলেন, “আমি কিছু একটা লিখছিলাম। হঠাৎই পুরো ভবন ঝাঁকুনি দিতে শুরু করে। আমার কেমন লাগছিল, তা বোঝাতে পারবো না। মনে হয় চার-পাঁচ মিনিট ধরে এটা হয়েছে। এটা ভয়ঙ্কর ছিল।”ফিলিস্তিনের গাজা থেকে প্রায় ৪৫ সেকেন্ডের মত ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে বলে জানান বিবিসির একজন প্রতিনিধি।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য

error: <b>Alert: </b>Content selection is disabled!!