Saturday, January 18, 2025
বাড়িবিশ্ব সংবাদহ্যারির স্মৃতিকথনে রাজবংশে কালির ছোপ

হ্যারির স্মৃতিকথনে রাজবংশে কালির ছোপ

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক,১১ জানুয়ারি: দেখার আগেই চলছিল আলোচনা, প্রিন্স হ্যারির স্মৃতিকথা ‘স্পেয়ার’ এখন পৌঁছে গেছে পাঠকের হাতে। যুক্তরাজ্যের বর্তমান রাজা তৃতীয় চার্লস ও প্রয়াত প্রিন্সেস ডায়ানার ছোট ছেলে হেনরি চার্লস অ্যালবার্ট ডেভিড, প্রিন্স হ্যারি নামেই তার পরিচিতি, রাজকীয় উপাধি তার ডিউক অব সাসেক্স। তবে রাজকীয় দায়িত্ব তিনি ছেড়ে দিয়েছেন আগেই।হাজার বছরের রাজপরিবারের সন্তান, আবার ঠিক রাজপরিবারে নেই- হ্যারির এমন অবস্থা তার স্মৃতিকথার নাম হয়ে এসেছে। তিনি বইটির নাম রেখেছেন- ‘স্পেয়ার’, দৃশ্যত তিনি এটাই বোঝাতে চেয়েছেন যে তিনি ‘স্পেয়ার এয়ার’ বা সিংহাসনের অতিরিক্ত বা অপ্রয়োজনীয় উত্তরাধিকারী।

মঙ্গলবার সাধারণ পাঠকের নাগালে আসার আগেই অবশ্য এই বই নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে ব্যাপক আলোচনা শুরু হয়। প্রকাশের নির্ধারিত সময়ের আগেই যুক্তরাজ্যের দ্য গার্ডিয়ান এই বইয়ের একটি কপি সংগ্রহ করে এবং এর চুম্বক অংশ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে। যুক্তরাষ্ট্রের সিএনএনও আলোচিত বইটির একটি সংগ্রহ করে তার উল্লেখযোগ্য অংশ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।আত্মজীবনী হিসেবে লেখা এই বইয়ে ব্রিটেনের রাজপরিবার থেকে বের হয়ে আসা এই রাজপুত্র তার পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ব্যক্তিগত দূরত্ব ও টানাপড়েনের ঘটনা তুলে ধরেছেন। লিখেছেন, কী পরিস্থিতিতে তিনি ও তার স্ত্রী বাধ্য হয়েছেন রাজ পরিবার ছেড়ে আসতে। বড় ভাই, যুবরাজ উইলিয়ামসের সঙ্গে ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং রাজপরিবারের সঙ্গে তার দূরত্ব সৃষ্টির বিভিন্ন ঘটনা উঠে এসেছে বইটিতে।প্রাসাদের আড়ালে থাকা অনেক ঘটনা প্রকাশ্যে চলে এসেছে হ্যারির এই বইয়ের মধ্য দিয়ে, যা রাজ পরিবারের জন্য স্পষ্টতই বিব্রতকর। গার্ডিয়ানে এক কলামনিস্ট বই প্রকাশের পর লিখেছেন- এখন যে কেউ বলতে পারে, ব্রিটেনের প্রথম পরিবারের ভেতরেই যদি এমন সব ঘটনা ঘটে, তাহলে সবার কী অবস্থা?‘স্পেয়ারে’ বর্ণনা করা বিভিন্ন ঘটনাবলী নিয়ে রাজপরিবার এখনও রয়েছে নিশ্চুপ। বিশেষ করে কেনসিংটন প্রাসাদ ও বাকিংহ্যাম প্রাসাদ থেকে এসব ঘটনার বিষয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য বা বিবৃতি আসেনি।

তবে সব মিলিয়ে বইটিতে আসা নানা ঘটনা ঘিরে দারুণ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে সাধারণ পাঠকের মধ্যে, বিশেষ করে যুক্তরাজ্যে এবং বিশ্বে যারা ব্রিটিশ রাজপরিবার সম্পর্কে জানতে আগ্রহী, তাদের মধ্যে। ‘স্পেয়ারে’ হ্যারির সবচেয়ে বিস্ফোরক দাবিগুলোর একটি হচ্ছে, তার বড় ভাই প্রিন্স উইলিয়াম ডাচেস অব সাসেক্স মেগানকে নিয়ে তর্কের সময় তাকে মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিলেন।কথিত এই হাতাহাতি হয়েছিল দুই ভাইয়ের কথোপকথনের পরে। ব্রিটিশ সিংহাসনের উত্তরাধিকারী উইলিয়াম ওই তর্কের সময় মেগানকে ‘অনমনীয়’, ‘অভদ্র’ এবং ‘অনুভূতিহীন’ বলে আখ্যায়িত করেন।হ্যারি লিখেছেন, উইলিয়াম “আমার কলার চেপে ধরে, আমার নেকলেস ছিঁড়ে ফেলে, এবং … আমাকে মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়।”

ঘটনার বিস্তারিত বিররণ দিয়ে ডিউক অব সাসেক্স লিখেছেন, “তাদের সম্পর্কের ‘পুরো বিপর্যয়কর বদলে যাওয়া’ এবং সংবাদ মাধ্যমের সঙ্গে টানাপোড়েন” নিয়ে আলোচনা করার জন্য লন্ডনের কেনসিংটন প্রাসাদে হ্যারি ও মেগানের তৎকালীন বাসভবন নটিংহাম কটেজে যান উইলিয়াম।হ্যারি দাবি করেছেন, উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর বড় ভাইকে পানি পান করতে দিয়েছিলেন এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টাও করেছিলেন, এমন সময় উইলিয়াম তাকে আক্রমণ করে বসেন।

“তিনি পানির গ্লাস নামিয়ে রাখলেন, আমাকে গালি দিলেন, তারপর আমার দিকে তেড়ে এলেন। সবকিছু খুব দ্রুত ঘটল। খুবই দ্রুত। তিনি আমার কলার ধরে, আমার নেকলেস ছিঁড়ে, আমাকে ধাক্কা দিয়ে মেঝেতে ফেলে দেন। আমি মেঝেতে রাখা কুকুরের খাবারের বাটির ওপর পড়ে যাই। বাটিটি পিঠের নিচে পড়ে ভেঙে যায়, টুকরোগুলো আমার পিঠে গেঁথে যায়। আমি কিছুক্ষণের জন্য হতবিহ্বল হয়ে সেখানে শুয়ে থাকি। তারপর উঠে দাঁড়িয়ে তাকে বেরিয়ে যেতে বলি।”বইয়ে হ্যারি বলেছেন, উইলিয়াম তাকে পাল্টা আঘাত করার আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি করেননি। উইলিয়াম বেরিয়ে যান। কিন্তু পরে আবার ফিরে আসেন ‘অনুতপ্ত মুখে’ এবং যা করেছেন তার জন্য ক্ষমা চান।রোববার সম্প্রচারিত ব্রিটেনের আইটিভির সঙ্গে সাক্ষাত্কারে হ্যারি এই বিবাদের বিশদ বর্ণনা করেন এবং স্মরণ করেন যে ওই সময় তার মনে হয়েছিল, যেন একটি ‘লাল রঙের কুয়াশা’ উইলিয়ামকে ঘিরে ধরেছে।“এখানে আলাদা করে বলার ছিলো হতাশার মাত্রা, এবং আমি লাল কুয়াশার কথা বলছি, যা এত বছর ধরে আমাকে ঘিরে রেখেছিলো, এবং আমি তার মধ্যে এই লাল কুয়াশা দেখেছি। সে চেয়েছিল যে আমি তাকে আঘাত করি, কিন্তু আমি করিনি।”

ছেলেদের কাছে রাজা চার্লসের আবেদন

বইয়ের প্রথম দিকে, ২০২১ সালের এপ্রিলে রাজপরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যের মর্যাদা ছেড়ে বের হয়ে আসার পর, রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের স্বামী প্রিন্স ফিলিপের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় যোগ দিতে প্রথমবার যুক্তরাজ্যে ফেরার কথা স্মরণ করেন হ্যারি।শোকের এই ঘটনাটি ছিল, অপরাহ উইনফ্রের সঙ্গে তার ও মেগানের ‘বিস্ফোরক’ সাক্ষাৎকারের পর, প্রথমবার বাবা এবং বড় ভাই উইলিয়ামের সঙ্গে আবার দেখা করা ও কথা বলার উপলক্ষ।

“যদিও আমি সুনির্দিষ্টভাবে এবং একমাত্র দাদার অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার জন্যই বাড়ি গিয়েছি, সেখানে আমি এই পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার জন্য আমার বড় ভাই উইলি ও বাবার সঙ্গে গোপন বৈঠক করেছিলাম। আমরা বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছিলাম। আমি আমার দিকটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। আমি তখনও নার্ভাস ছিলাম, আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখার লড়াই করছিলাম, পাশাপাশি বক্তব্য সংক্ষিপ্ত এবং সুনির্দিষ্ট রাখারও চেষ্টা করছিলাম।”হ্যারি বলেছেন, তিনি আবিষ্কার করেছিলেন যে তার ভাই এবং বাবা (তার সঙ্গে) লড়তে প্রস্তুত ছিলেন।হ্যারির স্মৃতিকথা ইঙ্গিত দেয় যে উইলিয়ামের সঙ্গে উত্তেজনা তখনও কমেনি এবং চার্লস তার ছেলেদের কাছে অনুরোধ করেছিলেন তার ‘শেষ বছরগুলো আর দুঃখজনক না করার জন্য’।ওই অনুচ্ছেদ থেকে আরও জানা যায় যে ভাইয়েরা পরস্পরকে ‘উইলি’ ও ‘হ্যারল্ড’ নামেই ডাকতেন।

স্মৃতিকথায় হ্যারি আরও দাবি করেছেন যে চার্লসও একবার হ্যারির বাবা ‘আসলে কে’, তা নিয়ে রসিকতা করেছিলেন। তার বাবা ‘গল্প বলা পছন্দ করতেন’ জানিয়ে হ্যারি লিখেছেন, মেজর জেমস হিউইটের সঙ্গে তার মা ডায়ানার সম্পর্ক নিয়ে রসিকতা করেছিলেন (তৎকালীন) প্রিন্স চার্লস।

তার বাবা রসিকতা করে বলেছিলেন, “আমি সত্যিই প্রিন্স অব ওয়েলস কিনা কে জানে? আমি তোমার আসল বাবা কিনা কে জানে? হয়ত তোমার আসল বাবা ব্রডমুর, ডিয়ার বয়!”হ্যারি একে একটি ‘কৌতুক হিসেবে নিতে পারেননি’, কারণ ওই সময়নই গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে ‘আমার প্রকৃত বাবা হয়ত আমার মায়ের সাবেক প্রেমিকদের একজন- মেজর জেমস হিউইট’।সাবেক প্রিন্সেস অব ওয়েলস ডায়ানা, বিবিসি প্যানোরামায় সাংবাদিক মার্টিন বশিরের সঙ্গে সাক্ষাৎকারে হিউইটের সঙ্গে তার পাঁচ বছরের সম্পর্ক ছিল বলে স্বীকার করেন। তিনি বলেছিলেন যে সম্পর্কটি ১৯৮৬ সালে শুরু হয়েছিল, ডিউক অব সাসেক্সের জন্মের দুই বছর পরে।

হ্যারি লিখেছেন, “এই গুজবের একটি কারণ ছিল মেজর হিউইটের চুলের রঙ, কিন্তু আরেকটি কারণ ছিল ‘স্যাডিজম’ (পাশবিকতা)। ট্যাবলয়েড পাঠকরা এই ধারণা থেকে আমোদ পেয়েছিল যে প্রিন্স চার্লসের ছোট ছেলে তার ঔরসজাত নয়। এটা কেউ মনেও রাখেনি যে আমার জন্মের অনেক পরে পর্যন্ত আমার মা মেজর হিউইটের সঙ্গে দেখা করেননি। গল্পটি এতোই মুখরোচক ছিল যে তা বাদ দেওয়া খুব মুশকিল ছিল।”প্রিন্স হ্যারি যোগ করেছেন যে রাজা যদি মেজর হিউইট সম্পর্কে কিছু ভেবেও থাকতেন, “তার উচিত ছিল সেটা নিজের ভেতরে রাখা।”

ক্যামিলাকে বিয়ে না করতে বাবাকে অনুরোধ

আত্মজীবনীর আরেকটি ঘটনায়, ক্যামিলাকে, যিনি এখন কুইন কনসোর্ট, বিয়ে না করতে বাবাকে অনুরোধ করার ঘটনা স্মরণ করেছেন হ্যারি। তার ভয় ছিল যে ক্যামিলা একজন ‘দুষ্ট সৎ মা’ হবেন।“আমার মনে আছে, চা পানের ঠিক আগে ভাবছিলাম, যদি তিনি আমার সঙ্গে বাজে আচরণ করেন। যদি তিনি গল্পের বইয়ের সমস্ত দুষ্ট সৎ মায়ের মতো হন। কিন্তু তিনি তা ছিলেন না। উইলির মতো, আমিও এর জন্য সত্যিকারের কৃতজ্ঞতা অনুভব করি।”

বইটি থেকে জানা যায়, উইলিয়াম ও হ্যারি উভয়েই ক্যামিলাকে ‘আদার ওম্যান’ বলে অভিহিত করেছিলেন।হ্যারি দাবি করেছেন, বড় ভাই উইলিয়াম অনেক আগে থেকেই তাদের বাবার বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্ক নিয়ে সন্দেহ করে আসছিলেন।হ্যারি লিখেছেন, যখন তাদের বাবা ক্যামিলার সঙ্গে তার সম্পর্কের বিষয়টি জনসমক্ষে প্রকাশ করতে যাচ্ছিলেন, তখন তারা দুই ভাই আলাদাভাবে প্রথমবার আনুষ্ঠানিকভাবে বাবার সঙ্গে দেখা করেছিলেন।হ্যারি বলেন, “তিনি (উইলিয়াম) আমাকে শুধু এই ধারণা দিয়েছিলেন যে অন্য মহিলা, ক্যামিলা, একটি প্রচেষ্টা চালিয়েছেন যা তিনি প্রশংসা করেন এবং তিনি এটুকুই বলেছিলেন।” হ্যারি পরে ক্যামিলার সঙ্গে তার দেখা হওয়াকে একটি ইনজেকশন নেওয়ার সঙ্গে তুলনা করে লেখেন, “চোখ বন্ধ করুন, আপনি বোঝার আগেই এটা শেষ হয়ে যাবে।”

মায়ের মৃত্যুর দুঃসহ স্মৃতি

হ্যারি তার স্মৃতিকথায় স্বাভাবিকভাবেই তার মা ডায়ানার মৃত্যুর প্রসঙ্গ টেনেছেন। ফ্রান্সের প্যারিসে টানেলের ভেতরে গাড়ি দুর্ঘটনায় ডায়ানা ও আরও দুজন নিহত হন। ডায়ানা ১৯৯৭ সালে যখন মারা যান, যখন হ্যারির বয়স ছিল ১২ বছর।হ্যারি লিখেছেন, ২০০৭ রাগবি বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে অংশগ্রহণের জন্য তাকে ফ্রান্সের রাজধানীতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল এবং তাকে একজন ড্রাইভার দেওয়া হয়েছিল। শহরে তার প্রথম রাতে তিনি ড্রাইভারকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন যে তিনি সুড়ঙ্গটি চেনেন কিনা – পন্ত দে ল’আলমা – যেখানে ডায়ানার গাড়িটি ১৯৯৭ সালে বিধ্বস্ত হয়েছিল।

হ্যারি গাড়িচালককে ঘণ্টায় ৬৫ মাইল বেগে গাড়ি চালাতে বলেছিলেন, কারণ বিধ্বস্তের সময় পুলিশের মতে তার মায়ের গাড়িটি এই গতিতেই চলছিল।আমি সবসময় ভেবে এসেছি টানেলটি হয়ত বিপজ্জনক ছিল, হয়ত কঠিন ছিল এর মধ্যে দিয়ে গাড়ি চালানো। কিন্তু (আমি দেখলাম) এটি ছিল একটি সংক্ষিপ্ত, সরল, নো-ফ্রিলস টানেল। এর ভেতরে কারও কখনও মারা যাওয়ার কারণ থাকতে পারে না।”হ্যারি আরও লিখেছেন যে তিনি তার ড্রাইভারকে আরও একবার টানেল দিয়ে যাওয়ার অনুরোধ করেন।“এটা খুবই একটা খারাপ পদক্ষেপ ছিল। আমার ২৩ বছরের জীবনে আমার অনেক বিপজ্জনক ভাবনা ছিল। কিন্তু এটি ছিল অনন্যভাবে খারাপ একটি ভাবনা। আমি নিজেকে বলেছিলাম যে আমি বের হয়ে আসতে চাই এই দুঃসহ স্মৃতি থেকে। কিন্তু সত্যিই আমি পারিনি।

“হৃদয়ের গভীরে, আমি আশা করেছিলাম ওই টানেলের ভেতর দিয়ে গেলে আমার এই বিশ্বাসটি দৃঢ় হবে, যখন জেএলপি (জ্যামি লোথার পিংকারটন, হ্যারি এবং প্রিন্স উইলিয়ামের প্রাক্তন প্রাইভেট সেক্রেটারি) আমাকে পুলিশ ফাইল দিয়েছিল- অবিশ্বাস। সন্দেহ। পরিবর্তে, সেই রাতেই সমস্ত সন্দেহ দূর হয়ে গেল।”“আমি ভেবেছিলাম টানেলে গাড়ি নিয়ে যাওয়ার ভেতর দিয়ে আমার যন্ত্রণার অবসান ঘটবে বা সংক্ষিপ্তভাবে আমি বের হয়ে আসতে পারব। বরং, নতুন করে যেন যন্ত্রণাটি উস্কে উঠলো, অদম্য কষ্ট।”রোববার ব্রিটেনে আইটিভিতে সম্প্রচারিত ‘হ্যারি: দ্য ইন্টারভিউ’ এর একটি ক্লিপে ডিউক তার মায়ের মৃত্যুর পর শোকাবিভূত দর্শনার্থীদের সঙ্গে দেখা করার স্মৃতি এবং ১৯৯৭ সালে তার মায়ের মৃত্যুর পরে কেনসিংটন প্রাসাদের বাইরে হাঁটার সময় তিনি যে অপরাধবোধ অনুভব করেছিলেন সে সম্পর্কে কথা বলেছেন।

হ্যারি বলেন যে তিনি তার মায়ের মৃত্যুর পর মাত্র একবার কেঁদেছিলেন, তার সমাধিতে। উপস্থাপক টম ব্র্যাডবিকে তিনি বলেন, “সবাই জানে আমার মা মারা যাওয়ার রাতে তারা কোথায় ছিল এবং তারা কী করছিল।”তিনি বলেন, “দাফন করার সময় আমি একবার কেঁদেছিলাম, এবং এটি কতটা অদ্ভুত ছিল তা বর্ণনা করেছি এবং কেনসিংটন প্রাসাদের বাইরে হাঁটার সময় আসলে তখন অপরাধবোধও ছিল এবং আমি মনে করি উইলিয়ামও একই অনুভূতির মধ্যদিয়ে গেছে।”হ্যারি শোকগ্রস্তদের কান্না অনুভব করার বর্ণনা দিয়েছেন এভাবে, “যে ভেজা হাতগুলো আমাদের সঙ্গে হাত মেলাচ্ছিল, আমরা বুঝতে পারছিলাম না কেন তাদের হাত ভেজা, অথচ হতগুলো ভেজা ছিল তাদের চোখের পানিতে।”

কেইট সম্পর্কে মেগানের মন্তব্য

হ্যারির এই স্মৃতিকথায় দুই রাজবধূর মধ্যেকার সম্পর্কের দূরত্বও উঠে এসেছে। হ্যারি লিখেছেন, ২০১৮ সালে মেগান তার ভাবি কেইট মিডলটনকে সম্ভবত এমন কিছু বলে চটিয়ে দিয়েছিলেন যে সন্তান জন্ম দেওয়ার সময় তার হরমোনের তারতম্যের কারণে তার ‘বুদ্ধি শিশুদের মতো’ হয়ে গেছে।হ্যারি তাদের বাসভবনে উইলিয়াম এবং কেইটের সঙ্গে ২০১৮ সালের একটি বৈঠকের বর্ণনা দিয়েছেন, যা ডিউকের মতে, উভয় দম্পতির মধ্যে সম্পর্ক ভালো করার একটি প্রচেষ্টা ছিল।

বইয়ে দাবি করা হয়েছে যে কেইট মেগানকে বলেছিলেন, “আমার হরমোন সম্পর্কে কথা বলার মতো ঘনিষ্ঠতা আমাদের মধ্যে নেই!” মেগান বলেছিলেন যে তিনি তার সব বন্ধুর সঙ্গে এভাবেই কথা বলেন।হ্যারি উল্লেখ করেছেন যে প্রিন্স অফ ওয়েলস মেগানকে “অভদ্র” বলেছেন এবং তার দিকে আঙুল তুলে বলেছেন, “এখানে ব্রিটেনে এই আচরণ চলে না।” জবাবে মেগান বলেছিলেন, “দয়া করে আমার মুখের সামনে থেকে আপনার আঙুল সরিয়ে নিন।”“মেগ বলেছিলেন যে তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে কেইটকে আঘাত করার জন্য কখনও কিছু করেননি, এবং যদি তিনি কখনও তা করে থাকেন তবে তিনি কেইটকে দয়া করে তা জানানোর অনুরোধ করেন যাতে এটি আর না ঘটে,” হ্যারি লিখেছেন।

আফগানিস্তানে হত্যার সংখ্যা প্রকাশ

প্রিন্স হ্যারি আফগানিস্তানে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যুদ্ধের সময় ২৫ জনকে হত্যা করার দাবি করেছেন, বলেছেন যে যুদ্ধের উত্তাপের মুহূর্তে তিনি তার লক্ষ্যবস্তুগুলোকে মানুষের চেয়ে ‘দাবার গুটি’ হিসেবেই দেখেছিলেন।তিনি দুই মেয়াদে আফগানিস্তানে দায়িত্ব পালন করেছেন। একটি ২০০৭ থেকে ২০০৮ সালে এবং অন্যটি ২০১২ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত।হ্যারি বলেন, “আমি মনে করি যে এই সংখ্যার বিষয়টি আড়াল না করা গুরুত্বপূর্ণ। আমার সংখ্যা: পঁচিশ। এটি এমন একটি সংখ্যা যা আমাকে কোনো আনন্দ দেয় না। তবে এটা আমাকে লজ্জায়ও ফেলে না।”“২৫ জনকে মানুষ হিসাবে ভাবিনি। মানুষকে মানুষ মনে করলে মারতে পারবেন না। আপনি যদি মানুষকে মানুষ মনে করেন, তবে আপনি তাদের ক্ষতি করতে পারবেন না। আমার কাছে তারা ছিল দাবার বোর্ডের গুটির মতো। খারাপরা ভালোর ক্ষতি করার আগেই খারাপদের সরিয়ে দেওয়া।”যুদ্ধের ময়দানে এই হত্যার যৌক্তিকতার ব্যাখ্যায় হ্যারি লিখেছেন, তিনি ভালো সামরিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন এবং একে দয়িত্ব পালনের অংশ হিসেবেই দেখেছেন।মন্তব্যটি কিছু ব্রিটিশ নিরাপত্তা এবং সামরিক ব্যক্তিত্বের সমালোচনার জন্ম দিয়েছে – এবং তালেবানদের কাছ থেকে একটি ক্ষুব্ধ তিরস্কার।

মাদক সেবন এবং প্রথম যৌনাচার

স্ত্রী মেগান ও দুই সন্তানকে নিয়ে বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ায় বসবাসকারী হ্যারি স্বীকার করেছেন, তিনি ১৭ বছর বয়সে কোকেন গ্রহণ করেছেন। তবে তিনি এ নিয়ে খুব খুশিও ছিলেন না তিনি।হ্যারি লিখেছেন, “কিন্তু এটা আমাকে অন্যরকম অনুভব করাতে সাহায্য করেছে এবং এটাই ছিল মূল লক্ষ্য। অনুভব করা। আমি একটি গভীরভাবে অসুখী ১৭ বছর বয়সী বালক ছিলাম যে স্থিতাবস্থাকে পরিবর্তন করতে পারে এমন কিছু চেষ্টা করতে ইচ্ছুক।”

যুবরাজ হ্যারি এর আগে তার কৈশোরে মাদক সেবনের কথা স্বীকার করেছেন। ২০০২ সালে, যখন তিনি ১৬ বছর বয়সী স্কুলছাত্র ছিলেন, তখন তিনি মদ্যপান এবং গাঁজা ব্যবহারের অভিযোগের সম্মুখীন হন, যা নিয়ে সিএনএন এরআগে প্রতিবেদন করেছিল।আত্মজীবনীতে হ্যারি তার প্রথম সঙ্গমেরও বর্ণনা দিয়েছেন যাকে তিনি ‘অভিমানজনক পর্ব’ বলেছেন।হ্যারি জানিয়েছেন, তিনি ‘একজন বয়স্ক নারীর’ সঙ্গে প্রথম সঙ্গম করেছেন, যিনি “ঘোড়া পছন্দ করতেন অনেক বেশি এবং তার সঙ্গে ‘একটি অল্পবয়সী ঘোড়ার মতো আচরণ করেননি’।বইটিতে ওই নারীর নাম প্রকাশ করেননি হ্যারি।

ট্যাবলয়েডে প্রকাশিত কেলেঙ্কারি

আত্মজীবনীতে ২০০৫ সালের একটি পার্টিতে নাৎসি পোশাক পরার বিতর্কিত ঘটনাও তুলে এনেছেন ডিউক। হ্যারি অভিযোগ করেন, প্রিন্স উইলিয়াম এবং তার স্ত্রী ক্যাথরিন তা পরতে তাকে উৎসাহিত করেছিলেন।২০০৫ সালে, যুক্তরাজ্যের সান পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ছবিতে, একটি কস্টিউম পার্টিতে হ্যারিকে একটি জার্মান সামরিক জ্যাকেটের উপর একটি স্বস্তিকা আর্মব্যান্ড পরা অবস্থায় দেখা যায়।সেই সময়ে, হ্যারি ঘটনার দায়ভার গ্রহণ করেন এবং ক্লারেন্স হাউস প্রেস অফিসের মাধ্যমে একটি ক্ষমাপ্রার্থনা করে বিবৃতি দেন এই বলে যে “অত্যন্ত দুঃখিত যদি আমি কারও কাছে কোনো অপরাধ বা বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করে থাকি। এটি পোশাকের একটি দুর্বল পছন্দ ছিল এবং আমি ক্ষমাপ্রার্থী।”তবে আত্মজীবনীতে হ্যারির নতুন দাবি যে তার ভাই এবং ভাবির প্ররোচনায় তিনি নাৎসি চিহ্নযুক্ত পোশাক পরেন, যা তার আগের বিবৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

তিনি ২০০৯ সালের আরেকট স্ক্যান্ডাল নিয়েও কথা বলেছেন। ওই সময় একজন পাকিস্তানি সহযোদ্ধাকে বর্ণনা করার সময় হ্যারি ‘জাতিগত বর্ণবাদের’ আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে অভিযোগ ওঠে। এ নিয়ে তার একটি ভিডিও তখন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছিল।হ্যারি বলেন, যে তিনি একটি বিমানবন্দরে সময় কাটাতে গিয়ে তিনি এবং তার কিছু সহকর্মী ক্যাডেটদের কিছু ভিডিও শুট করেছিলেন।

“আমি দলটিকে প্যান করেছিলাম, প্রতিটি ছেলের উপর একটি চলমান ধারাভাষ্য দিয়েছিলাম, এবং যখন আমি আমার সহকর্মী এবং একজন ভালো বন্ধু পাকিস্তানের আহমেদ রাজা কানের কাছে আসি, তখন আমি বলেছিলাম: আহ, আমাদের ছোট পাকি বন্ধু…।”হ্যারি লিখেছেন, তিনি জানতেন না যে শব্দটি একটি গালি হিসেবে ব্যবহার হয়। বইয়ে এ বিষয়ে তিনি তার বয়স ও অজ্ঞতার অজুহাত তুলে ধরেন।ফুটেজটি বছরের শেষের ভিডিওর জন্য একজন সহ-ক্যাডেটের কাছে পাঠানো হয়েছিল জানিয়ে হ্যারি লিখেছেন, কিন্তু তারপরে এটি প্রচার করা হয়েছিল এবং শেষে এমন একজনের হাতে শেষ হয়েছিল যে এটি নিউজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড (বন্ধ হয়ে যাওয়া সংবাদপত্র) এর কাছে বিক্রি করেছিল।হ্যারি বর্ণনা করেছেন যে ভিডিওটি প্রকাশ্যে আসার পরে তার বাবার অফিস তার পক্ষে দুঃখপ্রকাশ করে একটি বিবৃতি দেয় এবং তিনি নিজেও একটি বিবৃতি দিতে চেয়েছিলেন কিন্তু তাকে সেটা করতে দেওয়া হয়নি।

রানিকে শেষবিদায়

রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথকে শেষ বিদায় জানানোর স্মৃতিও স্মরণ করেছেন হ্যারি, যা নিয়ে অনেকেরই আগ্রহ রয়েছে।হ্যারি জানান, গত সেপ্টেম্বরে বাবা চার্লসই ফোন করে প্রথম বলেছিলেন যে রানির স্বাস্থ্য ‘একটা বাঁক নিয়েছে’।স্মৃতিকথায় হ্যারি দাবি করেছেন, বাবার ফোন পাওয়ার পরপরই তিনি ভাই উইলিয়ামকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে তিনি এবং তার ভাবি কেইট বালমোরাল প্রাসাদে যাচ্ছেন কি না কিংবা কখন ও কীভাবে যাবেন? তবে উইলিয়ামের কাছ থেকে কোনো জবাব পাওয়া যায়নি।

তিনি লিখেছেন, তারপর তিনি বাবা চার্লসের কাছ থেকে আরেকটি ফোন কল পেয়েছিলেন, তখন বলা হয়েছিল যে তাকে স্কটিশ বাসভবনে স্বাগত জানানো হবে, কিন্তু তার স্ত্রী মেগানকে নয়।শেষবার তার দাদীর সঙ্গে আলাপের স্মৃতিরোমন্থন করেছেন হ্যারি, “চার দিন আগে ফোনে লম্বা চ্যাট। আমরা অনেক বিষয়ে কথা বলি। তার স্বাস্থ্য, অবশ্যই ১০ নম্বর (ডাউনিং স্ট্রিটে) অস্থিরতা।”রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের মৃত্যু ও তার বাবার রাজা হওয়ার খবর পাওয়ার মুহূর্তও স্মরণ করেছেন হ্যারি। তিনি বালমোরাল প্রাসাদের একটি কক্ষে রানীর মৃতদেহ দেখার মুহূর্ত সম্পর্কেও সবিস্তারে লিখেছেন।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য