স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ১ জুলাই: ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর চলন্ত জিপে রক্তাক্ত ফিলিস্তিনি তরুণকে নিয়ে যাওয়ার ঘটনা ভাইরাল হওয়ার পর মুখ খুলেছেন আরও দুই ফিলিস্তিনি। গত সপ্তাহে দখল করা পশ্চিম তীরে তাঁদের জিপের বনেটের ওপর (ইঞ্জিনের ওপরের অংশ) বেঁধে গাড়ি চালিয়ে নিয়ে গিয়েছিল ইসরায়েলি সেনারা।গত শনিবার ওই দুই ফিলিস্তিনি বিবিসিকে নিজেদের ভয়ংকর অভিজ্ঞতার কথা বলেছেন। তাঁরা বলেছেন, জিপের বনেটের ওপর তাঁদের জোর করে তুলে দেয় ইসরায়েলি সেনারা। এরপর তারা জিপটি একটি গ্রামের রাস্তা ধরে চালিয়ে নিয়ে যায়। কখনো কখনো জিপটি দ্রুতগতিতে চালানো হয়।গত সপ্তাহে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া একটি ভিডিওতে দেখা যায়, রক্তাক্ত ফিলিস্তিনি তরুণকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী চলন্ত জিপের বনেটের ওপর বেঁধে রেখেছে। এ নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা হয়। পরে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এক বিবৃতিতে জানায়, আহত ফিলিস্তিনিকে এভাবে গাড়ির সামনে বেঁধে রেখে তাঁদের সেনারা প্রটোকল ভেঙেছে।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী এক বিবৃতি দিয়ে আহত ফিলিস্তিনিকে এভাবে গাড়ির সামনে বেঁধে রেখে তাঁদের সেনারা প্রটোকল ভেঙেছে বলে স্বীকার করেছে।পরে যে দুই তরুণ বিবিসিকে একই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হওয়ার কথা বলেছেন, তাঁদের একজন ২৫ বছর বয়সী সামির দাবায়া। গত সপ্তাহে জেনিন উপকণ্ঠের জাবারিয়াত এলাকায় অভিযান চালায় ইসরায়েলি বাহিনী। অভিযানের সময় পিঠে গুলিবিদ্ধ হন সামির। তিনি রক্তাক্ত অবস্থায় কয়েক ঘণ্টা মাটিতে মুখ থুবড়ে পড়েছিলেন। একপর্যায়ে সেনারা এসে তাঁকে পরীক্ষা করে।সামির বলেন, সেনারা যখন দেখতে পায় তিনি জীবিত আছেন, তাঁকে একটি বন্দুক দিয়ে আঘাত করে। এরপর তাঁকে তুলে ধরে জিপের ওপর ছুড়ে ফেলা হয়।সামির আরও বলেন, ‘তাঁরা ট্রাউজার খুলে নেয়। আমি গাড়ির ওপরটা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একজন সেনা আমার মুখে আঘাত করে এবং ধরতে মানা করে। এরপর তারা গাড়ি চালাতে শুরু করে। আমি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’সামির বিবিসিকে একটি ভিডিও ফুটেজ দেখিয়েছেন। একটি নিরাপত্তা ক্যামেরায় সেটি ধারণ করা হয়েছে। ভিডিওতে দেখা যায়, সামির অর্ধনগ্ন অবস্থায় দ্রুতগতিতে চলা একটি জিপের ওপর শুয়ে আছেন। জিপের গায়ে খুবই স্পষ্ট করে ‘ওয়ান’ লেখা আছে।
‘তাঁরা আমরা ট্রাউজার খুলে নেয়। আমি গাড়ির ওপরটা আঁকড়ে ধরতে চেয়েছিলাম। কিন্তু একজন সেনা আমার মুখে আঘাত করে এবং ধরতে মানা করে। এরপর তাঁরা গাড়ি চালাতে শুরু করে। আমি মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করছিলাম।’ইসরায়েলি সেনারা যেখানে অভিযান চালিয়েছে, সেই এলাকার সঙ্গে ভিডিওতে দেখানো এলাকার মিল রয়েছে। তবে ভিডিওটি কবে বা কখন ধারণ করা হয়েছে, তার কোনো স্পষ্ট প্রমাণ নেই। সামির বর্তমানে জেনিনের একটি হাসপাতালে ভর্তি আছেন।আরেক ফিলিস্তিনি হিশাম ইসলেইত। তিনি বিবিসিকে বলেন, জাবারিয়াতে অভিযানের সময় তিনি দুবার গুলিবদ্ধ হয়েছেন। একই ধরনের একটি সামরিক জিপ, যেটিতে ‘ওয়ান’ লেখা আছে, তাঁকে সেটির ওপর জোর করে তোলা হয়।
হিশাম বলেন, ‘চারদিক থেকে গুলি চলছিল। আমি দৌড়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পায়ে গুলিবিদ্ধ হই। এরপর সেনাদের একটি ইউনিট এসে আমাকে এবং আরও একজনকে তুলে নিয়ে যায়। তিনি আরও বলেন, ‘আমি খালি পায়ে ছিলাম, ইসরায়েলি সেনারা পোশাক খুলে নেয়। আমি জিপের ওপর হাত রাখার চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি, ওটা ছিল আগুনের মতো গরম। আমি তাদের বলেছিলাম এটা খুব গরম। এরপরও তারা আমাকে বনেটের ওপর চড়তে বাধ্য করে। তারা আমাকে বলেছিল, যদি আমি মরতে না চাই, আমাকে এটা করতে হবে।’বিবিসি থেকে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীকে এ অভিযোগের বিষয়ে জানানো হয়েছে। তারা বলেছে, তারা ঘটনাগুলো খতিয়ে দেখছে।আমি খালি পায়ে ছিলাম, গায়ে পোশাকও ছিল না। আমি জিপের ওপর হাত রাখার চেষ্টা করেছিলাম, পারিনি। ওটা ছিল আগুনের মতো গরম। আমি তাদের বলেছিলাম এটা খুব গরম। এরপরও তাঁরা আমাকে বনেটের ওপর চড়তে বাধ্য করে। তারা আমাকে বলেছিল, যদি আমি মরতে না চাই, আমাকে এটা করতে হবে।’
গত সপ্তাহে যে ভিডিও ভাইরাল হয়, সেটিতে থাকা রক্তাক্ত তরুণ ছিলেন ২৩ বছরের মুজাহিদ আবাদি বালাস। মুজাহিদও বর্তমানে হাসপাতালে ভর্তি। সেখান থেকে তিনি বিবিসিকে বলেন, ওই ঘটনার পরও বেঁচে থাকবেন, এমন আশা তিনি করেননি। চলন্ত গাড়ির ওপরে থেকেই তিনি স্রষ্টার কাছে শেষ প্রার্থনা করে নিয়েছিলেন।তিনি বিবিসিকে দ্বিতীয় আরেকটি ভিডিও দেখিয়েছেন। একই দূরত্ব থেকে ধারণ করা ওই ভিডিওতে ইসরায়েলি সেনারা যে তাঁকে গাড়ির ওপর ছুড়ে ফেলেছিল, তা বোঝা যাচ্ছে।মুজাহিদ বিবিসিকে আরও বলেন, ‘যখন তারা বুঝতে পারল আমার কাছে কিছুই (অস্ত্র) নেই। তারা জিপ থেকে নেমে এসে আমার মুখে, মাথায় এবং আমার ক্ষতস্থানে মারতে শুরু করে। সেনারা আমার হাত ও পা ধরে আমাকে তুলে ফেলে, ডানে-বাঁয়ে দোলায় এবং ছুড়ে ফেলে দেয়।’ওই তরুণের অভিযোগ, মাটিতে ছুড়ে ফেলার পর সেনারা আবার তাঁকে তুলে ধরে ডানে-বাঁয়ে দোলায় এবং জিপের ওপর ছুড়ে মারে এবং কাছের একটি বাড়িতে যায়।
ইসরায়েলি সেনাবাহিনী বলেছে, তারা এ সপ্তাহান্তে সন্দেহভাজন সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করতে জাবারিয়াতে অভিযান চালিয়েছে। ওই অভিযানের সময় ‘সন্ত্রাসীরা সেনাদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়েছে, জবাবে সেনারাও গুলি ছোড়ে।’এদিকে হিশাম দাবি করেছেন, তিনি ও মুজাহিদ অভিযানের দিন তাঁদের এক প্রতিবেশী বন্ধু মাজদ আল-আজমির সঙ্গে ছিলেন। মাজদকে ইসরায়েলি সেনারা গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেছে।আহত তিনজনই দাবি করেছেন, তাঁদের কাছে কোনো অস্ত্র ছিল না। তাঁদের পরিচয় পরীক্ষার পর ইসরায়েলি সেনারা তাঁদের ছেড়ে দেয়।ইসরায়েলি মানবাধিকার সংগঠন বৎসেলেম এ ধরনের ঘটনার ওপর নজর রাখে। সংগঠনটির মুখপাত্র বিবিসিকে বলেছেন, গত বছর ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার পর পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি সেনা ও ইহুদি বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা ফিলিস্তিনিদের ওপর নৃশংসতা রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছে গেছে; বিশেষ করে জেনিনে। সেখানে ৭ অক্টোবরের পর থেকে এখন পর্যন্ত ১২০ জনের বেশি বেসামরিক ফিলিস্তিনি ও ফিলিস্তিনি যোদ্ধাকে হত্যা করেছে ইসরায়েলি সেনারা।