Thursday, November 21, 2024
বাড়িস্বাস্থ্যঅটিজম (আত্মসংবৃতি/আত্মলীনতা )

অটিজম (আত্মসংবৃতি/আত্মলীনতা )

।। ডা. হৈমন্তী ভট্টাচাৰ্য ।। ২রা এপ্রিল বিশ্ব অটিজম সচেতনতা দিবস। অটিজম বলতে মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্ততাকে বোঝায়, যা বয়স তিন বছর হবার পূর্বেই প্রকাশ পায়। আত্মসংবৃত শিশুরা (যাদেরকে আত্মসংবৃত, আত্মলীন বা ইংরেজি

পরিভাষায় অটিস্টিক বলা হয়) সামাজিক আচরণে দুর্বল হয়, পারস্পরিক যোগাযোগের ক্ষেত্রে কম সক্ষম হয়। আচরণগত অসুবিধা, কথাবার্তার অসুবিধা ও সামাজিক মেলামেশা, অন্য বাচ্চাদের সঙ্গে মেলামেশা না করার প্রবণতা এই ৩টি জিনিস যখন থাকে একটি ৩ বছরের শিশুর মধ্যে, তখন সে অটিজমের বৈশিষ্ট্য বহন করছে বলে মনে করা হয়। তথ্য দেখায় যে অটিজম সহ ভাইবোনরা তাদের পিতার কাছ থেকে জেনেটিক উপাদানের প্রায় ৬৬ শতাংশ ভাগ করে নেয়, তাদের মায়ের কাছ থেকে প্রায় ৩০ শতাংশ

ভাগ করে নেয়।

অটিজম বা অটিস্টিক বাচ্চা জন্ম ভূমিষ্ঠ কারণ ঃ এক থেকে পাঁচ বছরের শিশুদের মধ্যে এই রোগ বিকশিত হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল জন্মের সময় মা বাবা, এমনকি চিকিৎসকরা অবধি এই রোগ শিশুদের মধ্যে ধরতে পারে না। ধীরে ধীরে বড় হওয়ার সাথে এই রোগের একাধিক উপসর্গ দেখা দেয়, যেখান থেকে এই অটিজম নির্ণয় করা হয়। অটিজম হওয়ার নানান কারণ রয়েছে। জিনগত কারণেও অটিজম হতে পারে। কিন্তু এই জিনগত কারণ একটু আলাদা। মা যদি গর্ভবস্থায় বা

গর্ভবর্তী হওয়ার আগে কোনও রোগে আক্রান্ত হন, সেখান থেকেও শিশুর মস্তিষ্কের ওপর প্রভাব পড়ে। অনেক ক্ষেত্রে শিশুর মধ্যে ক্রোমোজোমের সংখ্যা হ্রাস পেলে বা অস্বাভাবিক ভাবে বৃদ্ধি পেলে অটিজমের মত রোগ দেখা দেয়। থাইরয়েড সমস্যা

যা গর্ভাবস্থার ৮-১২ সপ্তাহে মায়ের মধ্যে থাইরক্সিনের ঘাটতির দিকে পরিচালিত করে ভ্রূণের মস্তিষ্কে অটিজমের দিকে নিয়ে যাওয়া পরিবর্তনগুলি তৈরি করে। থাইরক্সিনের ঘাটতি খাদ্যে অপর্যাপ্ত আয়োডিনের কারণে এবং পরিবেশগত এজেন্টদের কারণে হতে পারে যা আয়োডিন গ্রহণে হস্তক্ষেপ করে বা থাইরয়েড হরমোনের বিরুদ্ধে কাজ করে। মস্তিষ্কের স্নায়ুতন্ত্রের বিভিন্ন কোষগুলির পারস্পরিক সংযোগ কমে যাওয়ার ফলে অথবা স্নায়ু থেকে নিঃসৃত কিছু রাসায়নিক পদার্থের অভাবের ফলেও এই রোগ দেখা দেয়। তবে, অটিজম হওয়ার প্রধান কারণ এখনও জানা যায়নি। তাছাড়া গর্ভাবস্থায় পারিবারিক অশান্তি মায়ের স্বাস্থ্যের অবনতি, মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি এর প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে।

*

কাদের ঝুঁকি বেশি পরিসংখ্যানগতভাবে মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের মধ্যে অটিজম চারগুণ বেশি দেখা যায়। তবে যে কোনো জাতিগোষ্ঠী বা সামাজিক পটভূমির মানুষের মধ্যেই এই রোগ দেখা দিতে পারে। জীবনধারার সঙ্গে এর বিশেষ কোনো যোগ নেই। তবে

পরিবারে এই রোগের ইতিহাস থাকলে এই রোগের ঝুঁকি বাড়ে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। পাশাপাশি বেশি বয়সে সন্তানধারণ করলে, অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় অ্যালকোহল বা অ্যান্টি-সিজার জাতীয় ওষুধ খেলে অটিস্টিক শিশু জন্মানোর ঝুঁকি বেড়ে যায়। কিছু গবেষণায় ডায়াবিটিস, স্থূলতা, ফিনাইলকিটোনুরিয়া এবং রুবেলা এই রোগের আশঙ্কা বাড়িয়ে দিতে পারে বলে দাবি করা হলেও এ বিষয়ে আরও বিস্তারিত গবেষণা প্রয়োজন। অটিজমের উপসর্গগুলি : অটিজমে আক্রান্ত ঃ ১) শিশুরা চোখে চোখ মিলিয়ে কথা বলে না। ২) অন্যান্য শিশুদের সাথে মিশতে

চায় না।

৩) অনেক সময় অটিজমে আক্রান্ত শিশু অনেক বড় বয়সে কথা বলতে শেখে।

৪) নিজের নামে ডাকলে তারা কোনও রকম প্রতিক্রিয়া দেয় না। এটা দেখে অনেকের ধারণা হতে পারে যে, শিশুটি বধির।

৫) এরা কোনও একটি কাজ করতে ভালবাসে এবং সেই কাজটিই ক্রমাগত করতে থাকে। ৬) কোনও বিষয় বা বস্তুকে শব্দে, প্রতিক্রিয়া অথবা ইঙ্গিতে বোঝাতে এরা অক্ষম হয়।

কোনও চিকিৎসা নেই। লভ্য সমস্ত চিকিৎসা প্রয়োগ পদ্ধতির লক্ষ্য হল ব্যক্তিদের দুর্বলতা কমানো এবং স্বাবলম্বন এবং সম্ভাবনা বাড়ানো। যেহেতু মানসিক প্রতিবন্ধিত্বের পরিসরে থাকা প্রতিটি ব্যক্তি ভিন্ন হন এবং ভিন্ন ভিন্ন চাহিদা থাকে, তাঁদের জন্য পরিকল্পিত কর্মসূচী ব্যক্তিগত ভিত্তিক এবং অবশ্য‍ই একটা নির্ধারিত কাঠামোসম্পন্ন হবে। এই মানানসইকরণ গুরুত্বপূর্ণ হয় যেহেতু মানসিক প্রতিবন্ধিত্বের পরিসরে থাকা বেশির ভাগ ব্যক্তি অ্যাটেনশন ডেফিসিট হাইপারঅ্যাক্টিভিটি ডিজঅর্ডার-এর (এডিএইচডি) মত অন্যান্য ব্যাধিগুলির লক্ষণও প্রদর্শন করেন। এটা দেখা গিয়েছে যে যত আগে চিকিৎসাগুলি শুরু হবে, তত শীঘ্র ফলাফল দেখা যাবে। ব্যক্তি এবং তাঁর চাহিদার উপর নির্ভর করে নীচের কোর্সগুলির একটা সংমিশ্রণের উপর চিকিৎসাগুলি দেওয়া হয়।

আচরণগত ব্যবস্থাপনা থেরাপি : এটা একটা পদ্ধতি যা কাঙ্ক্ষিত আচরণ শক্তিশালী করা এবং অবাঞ্ছিত অথবা অগ্রহণযোগ্য আচরণ কমানোর দিকে লক্ষ্য রাখে। বিভিন্ন ধরণের সরঞ্জাম ব্যবহৃত হয় আচরণ টেনে বার করতে এবং

৭) অনেকের মধ্যে মুর্গীজনিত শক্তিশালী করতে যার অন্তর্ভুক্ত মূল রোগও দেখা দেয়।

৮) কখনও কখনও অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা কোনও একটি নির্দিষ্ট বিষয়ে পারদর্শী হয়। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের প্রথমেই বোঝা যায় না। বিকশিত হওয়ার সঙ্গে তার মধ্যে অটিজমের লক্ষণ গুলি দেখা যায়। সাধারণত তিন বছর বয়সে অটিজমের লক্ষণ গুলি শিশুদের মধ্যে সক্রিয় হয়। মূলত অটিজমে আক্রান্ত শিশুরা একা থাকতে ভালবাসে। তারা অন্য শিশুদের সঙ্গে খেলতে ভালবাসে না। খুব একটা কারোর সাথে কথা বলে না। কোনও প্রশ্নের সহজে উত্তর দেয় না বরং একটি কথাই বার বার পুনরাবৃত্তি করতে থাকে। অটিজম এর চিকিৎসা ঃ অটিজম উল্টে দেবার (পরিবর্তন করা)

প্রতিক্রিয়া প্রশিক্ষণ এবং ইতিবাচক আচরণ এবং ভরসা, এগুলো হচ্ছে তালিকার মাত্র কয়েকটি নাম। জ্ঞানমূলক আচরণ থেরাপি : থেরাপির এই রীতি ব্যবহার, চিন্তা এবং অনুভূতিগুলির উপর নজর দেয় এবং ব্যক্তিকে চিন্তা এবং ব্যবহার যা সমস্যামূলক পরিস্থিতি বা অনুভূতিগুলির দিকে চালিত করে সেগুলি চিহ্নিত করতে সাহায্য করে। এটা তাঁদের অনুভূতিগুলি চেনাতে এবং উদ্বেগের পরিস্থিতিগুলির সাথে মোকাবিলা করতে সাহায্য করে। যুগ্ম মনোযোগ থেরাপি ঃ এটা থেরাপির একটা গুরুত্বপূর্ণ দিক যেহেতু এটা আন্তঃব্যক্তিগত মেলামেশা এবং পারস্পরিক ক্রিয়ার উপর মনোযোগ দেয়। থেরাপির

এই পদ্ধতির দীর্ঘস্থায়ী ফল থাকে, যা এটাকে অত্যন্ত কার্যকর করে। দিকগুলি যেগুলির উপর মনোযোগ দেয় সেগুলির মধ্যে আছে যোগাযোগ এবং ভাষা এবং ভাগ করা মনোযোগ। ধারণাগুলি যেগুলির উপর প্রয়োগ করা হয় তার মধ্যে আছে মানুষ এবং বস্তুগুলির মধ্যে দৃষ্টি নিবন্ধ করা এবং সরানো পেশাগত থেরাপি ও পেশাগত থেরাপি শিশুদের নিয়মিত কাজ এবং রোজকার রুটিন সম্বন্ধে ক্ষমতা এবং চাহিদাগুলি খোঁজা এবং সম্পাদন করার উপরে মনোযোগ দেয়। থেরাপিস্ট বা বিশেষজ্ঞরা কতগুলি দিকের উপর কাজ করেন যেমন শিশুটির স্বাধীনভাবে পোশাক পরতে এবং খাবার খেতে, ব্যক্তিগত তদারক এবং যোগাযোগ, এবং অন্যান্য শারীরিক কাজকর্ম করতে সক্ষম হওয়া। শারীরিক থেরাপি ঃ অটিজম (আত্মমগ্নতা) পরিসরে যাঁরা থাকেন চলাফেরা হচ্ছে তাঁদের একটা সাধারণ সমস্যা, বেশির ভাগ ব্যক্তি শারীরিক থেরাপি গ্রহণ করেন। এই পদ্ধতি শক্তি গড়ে তুলতে এবং দেহভঙ্গী উন্নত করতে, এবং পেশীগত দক্ষতা বাড়াতে সাহায্য করে। যাই হোক, কোনও অকাট্য প্রমাণ নেই যা প্রমাণ করতে পারে যে এই থেরাপি চলাফেরায় কোনও উল্লেখযোগ্য পার্থক্য আনতে পারে কিনা।

সামাজিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ ও সামাজিক দক্ষতা প্রশিক্ষণ জোর দেয় শিশুদের ব্যবহার গড়ে তোলা এবং আরও বেশি সর্বব্যাপী পারস্পরিক ক্রিয়া অনুভব করতে তাদের সক্ষম করা। এটা কাঙ্ক্ষিত ধরণের উপর জোর দেয় এবং সেগুলিকে শক্তিশালী করে তোলে। এই দক্ষতার অন্তর্ভুক্ত কথাবার্তার উদ্যোগ নেওয়া, জ্বালাতন ( বিদ্রূপ) সামলানো এবং খেলোয়াড় সুলভ মনোভাব দেখানো।

কথা-ভাষা থেরাপিঃ এই থেরাপি স্বাভাবিক আদানপ্রদান অনুভব করতে সক্ষম হওয়ার জন্য মৌখিক বা বাচনিক এবং অ-মৌখিক

যোগাযোগ উভয়ের উপর নজর দেয়। উদ্দেশ্য হল ব্যক্তিদের তাদের অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা, বস্তুগুলির নাম বলা, অর্থপূর্ণ বাক্য গঠন করা এবং কণ্ঠস্বরের মাত্রার ওঠা-নামা আরও ভালোভাবে করতে সাহায্য করা। এটা আরও বেশি চোখের সংযোগ এবং ভাবভঙ্গী অনুমোদন করা এবং বার্তা জানাতে সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করতে সক্ষম হওয়াও অন্তর্ভুক্ত করে। পুষ্টিবিধান থেরাপি ঃ যেসমস্ত ব্যক্তির অটিজম (আত্মমগ্নতা/মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব) আছে তাঁদের বিভিন্ন পদ্ধতিতে পুষ্টিবিধানগত পরামর্শ দেওয়া হয় । এগুলির মধ্যে কয়েকটির পিছনে সত্যিই বৈজ্ঞানিক প্রমাণের সমর্থন আছে। লক্ষ্যটা হল নিশ্চিত করা যে অটিজম থাকা মানুষ যেন একটা স্বাস্থ্যকর এবং সুষম খাদ্য খান এবং পর্যাপ্ত পুষ্টি পান। অটিজম থাকা ব্যক্তিদের কয়েক ধরণের খাদ্যের প্রতি বিতৃষ্ণা থাকতে পারে (উদাহরণস্বরূপ, নরম এবং মণ্ডের মত খাবার )। প্রায়ই, অটিজমযুক্ত মানুষদের খাবারের সাথে মানসিক সংযোগ থাকার প্রবণতা থাকে – সেগুলিকে বমি বমিভাব এবং ব্যথার সাথে জড়িত করে। কিছু গবেষণা ইঙ্গিত দিয়েছে যে অটিজমযুক্ত মানুষদের অপেক্ষাকৃত পাতলা হাড় থাকার প্রবণতা থাকে। এইধরণের সমস্যাগুলি সামলাতে নিশ্চিত করা যে কোনও পুষ্টিগত অভাব নেই সেটা আরও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়ায়। অটিজম-এ ওষুধ প্রয়োগ অটিজম-এর জন্য কোনও প্রেসক্রাইব করা ওষুধ নেই বলা যায়। কিছু ক্ষেত্রে, বিশেষ কিছু অবস্থার জন্য যেগুলি মানসিক প্রতিবন্ধিত্ব থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে লক্ষণাত্মক, একজন বিশেষজ্ঞ ওষুধের বিধান দিতে পারেন। অ্যান্টিডিপ্রেস্যান্টস (অবসাদ- প্রতিরোধী), অ্যান্টিকন ভালস্যান্টস (খিঁচুনি বা তড়কা প্রতিরোধী), উদ্বেগ- প্রতিরোধী এবং অস্বাভাবিক সক্রিয়তার জন্য উদ্দীপক ওষুধ আছে। ওষুধ প্রয়োগের পদ্ধতির জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য