স্যন্দন ডিজিটাল ডেস্ক। আগরতলা। ২৭ নভেম্বর : সোমবার মেলার মাঠ স্থিত সিপিআইএমের সদর কার্যালয়ে ত্রিপুরা উপজাতি গণমুক্তি পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটি আয়োজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে উঠে আসে সাম্প্রতিক কালের সন্তান বিক্রির চাঞ্চল্যকর দৃষ্টান্ত। যা গত কয়েকদিন আগে ঘটেছিল তেলিয়ামুড়া মহকুমার অন্তর্গত মঙ্গিয়াকামি ব্লকের হলুদিয়া এডিসি ভিলেজের বংশী পাড়াতে।
বংশীপাড়া এলাকার বাসিন্দা খুকেন দেববর্মার দেড় দিনের কন্যা সন্তান ৩০ হাজার টাকার বিনিময়ে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। সোমবার সাংবাদিক সম্মেলনে প্রাক্তন মন্ত্রী নরেশ জমাতিয়া সেই দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন রাজ্য সরকার যেভাবে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় জনজাতি বিরোধী নীতি অবলম্বন করে চলেছে তাতে প্রচন্ড সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। আর এই কারণেই সন্তান বিক্রির মত ঘটনা ঘটে চলেছে। আগে বাবা মায়েরা তাদের সন্তানদের হত্যা করে নিজেরাও আত্মহত্যার পথ দেখে নিতো। এ ধরনের ঘটনাও ঘটেছিল জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায়। যা দুর্ভাগ্যজনক। ভারতীয় জনতা পার্টি অনুসৃত নীতির কারণে বিভিন্ন সরকারি ক্ষেত্রকে বেসরকারিকরণ করা, এর মানেই হচ্ছে সংরক্ষিত আসন গুলোকে অসংরক্ষিত করা।
কারণ বেসরকারি ক্ষেত্রে কোন ধরনের সংরক্ষিত আসন থাকে না। যার কারণে দেশজুড়ে জনজাতি ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রে কর্মসংস্থানের পরিবর্তে কর্ম সংকোচনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। বেসরকারি ক্ষেত্রে চাকরির সুযোগগুলোকে অসংরক্ষিত করে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রভাব পড়েছে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে।
প্রাপ্য তহবিল থেকে বঞ্চিত হচ্ছে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকা গুলো। ত্রিপুরা উপজাতি স্বশাসিত জিলা পরিষদ এলাকায় ভিলেজ কাউন্সিলের নির্বাচনকে স্তব্ধ করে দিয়ে বঞ্চিত করা হচ্ছে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকার সাধারণ মানুষের অধিকারকে। জনজাতি অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে জনজাতিদের ভূমি সুরক্ষার জন্য যে ব্যবস্থা ছিল অর্থাৎ বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে থাকা এডিসির নিজস্ব ল্যান্ড অ্যালটমেন্ট কমিটি সেগুলোকেও বাতিল করে দেওয়া হয়েছে। রেগার কাজ ও ঠিকভাবে দেওয়া হচ্ছে না। যার কারণে মানুষের আয় বৃদ্ধি পাচ্ছে না। বেড়ে চলেছে তাদের ব্যয়। এমন সব দুর্বিসহ ঘটনা ঘটে চলেছে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে। এই কারণে জনজাতি সুরক্ষা মঞ্চ সত্যিই কার অর্থে যদি জনজাতিদের সুরক্ষা চায় তাহলে সাধারণ মানুষকে বাঁচানোর জন্য ভারতীয় জনতা পার্টির সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে। এমনটাই আবেদন প্রাক্তন বন মন্ত্রীর। সাংবাদিক সম্মেলনে এদিন প্রাক্তন মন্ত্রী আরো বলেন আরএসএস অনুমোদিত জনজাতি সুরক্ষা মঞ্চ নামের একটি সংগঠন গত কয়েকদিন আগে একটি কর্মসূচির ঘোষণা দেয়। জনজাতি খ্রিস্টানদের জনজাতি তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবিতে আগামী ২৫ শে ডিসেম্বর আগরতলায় একটি রেলি করা হবে। এটাই ছিল জনজাতি সুরক্ষা মঞ্চের ঘোষিত কর্মসূচি। যা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ত্রিপুরা রাজ্য উপজাতি গণমুক্তি পরিষদ। বড়দিনের মত একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎসবের দিনে যেখানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের পাশাপাশি সকল ধর্মের সাধারণ মানুষ আনন্দের জোয়ারে মেতে উঠে গোটা বিশ্বজুড়ে, সেই জায়গায় সেই দিনটিতে খ্রিস্টানদের খ্রিস্টান বিরোধী করার দাবি নিয়ে মিছিল করার কর্মসূচি পুরোপুরিভাবে সাম্প্রদায়িক এবং প্ররোচনামূলক বলে মনে করেন প্রাক্তন বন মন্ত্রী নরেশ জমাতিয়া।
তিনি আরো বলেন জনজাতি খ্রিস্টানদের জনজাতি তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি পুরোপুরি অসংবিধানিক। ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে এ ধরনের উৎসব পালন করার ক্ষেত্রে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হওয়া উচিত নয়। একটা সময়ে এই রাজ্যে বেআইনি ঘোষিত এনএলএফটি সন্ত্রাসবাদীরা জনজাতি অধ্যুষিত এলাকায় দুর্গাপূজা এবং লক্ষ্মী পূজা নিষিদ্ধ করে দিয়েছিল। সেই সময়ে গণমুক্তি পরিষদ আন্দোলন সংগঠিত করেছিল। যার ফলশ্রুতিতে গণমুক্তি পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য হীরেন্দ্র জমাতিয়া এবং তার স্ত্রী এন এল এফ টি সন্ত্রাসবাদীদের হাতে নিহত হয়েছিলেন। সেই দৃষ্টিকোণ থেকে বড়দিনের উৎসবের মুহূর্তে জনজাতি সুরক্ষা মঞ্চের খ্রিস্টান বিরোধী মিছিলের কর্মসূচি রাজ্যের ঐতিহ্য বিরোধী বলে মনে করেন প্রাক্তন বন মন্ত্রী।
রাজ্যের প্রাক্তন বনমন্ত্রী নরেশ জমাতিয়া আরো বলেন অনগ্রসর জাতি সত্তার ভিত্তিতে জনজাতিদের তালিকা তৈরি করা হয় গোটা দেশজুড়ে। সেই হিসেবে খ্রিস্টান জনজাতিদের জনজাতিদের তালিকা থেকে বাদ দেওয়ার দাবি অযুক্তিক। জনজাতি খ্রিস্টানদের খ্রিস্টান স্বীকৃতি থেকে বাদ দেওয়া হলে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকাগুলোতে। জনজাতি খ্রিস্টানদের খ্রিস্টান স্বীকৃতি থেকে বাদ দিয়ে দিলে তারা অ জনজাতি ভুক্ত হয়ে পড়বে। সেই সময়ে জনজাতি অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে জনসংখ্যা ও কমবে। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সংসদ – বিধানসভা থেকে শুরু করে চাকরি – শিক্ষা- স্বাস্থ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে সংরক্ষিত আসন ধরা হয়ে থাকে জনজাতিদের জন্য। খ্রিস্টান স্বীকৃতি থেকে জনজাতিরা বাদ পড়ে গেলে জনজাতি জনসংখ্যার অনুপাতিক হারে জনজাতিদের জন্য সংরক্ষিত আসনের পরিমাণ ও কমে যাবে। যা জনজাতিদের জন্য একটা বিপর্যয়কর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে পারে। ভূমি থেকে জনজাতিরা উচ্ছেদ হয়ে থাকে কিংবা জনজাতিরা তাদের ভূমি হারায়। দেশে এর আগে এধরনের ঘটনাও ঘটেছে। ত্রিপুরা রাজ্য ডম্বুর প্রকল্পের সময়ে অনেক জনজাতি তাদের ভূমি ছাড়া হয়েছে। বর্তমানে সংবিধানে যে আইন রয়েছে তাতে জনজাতি ভূমি ও জনজাতিদের কাছে হস্তান্তর করা যাবে না। কিন্তু জনজাতিদের খ্রিস্টান স্বীকৃতি থেকে বাদ দিয়ে দিলে সংবিধানের এই আইন আর প্রযোজ্য থাকবে না। খ্রিস্টান স্বীকৃতি থেকে জনজাতিদের বাদ দিয়ে দিলে তারা অ জনজাতি ভুক্ত হয়ে পড়বে।
সেই সময়ে তারা অ জনজাতিভুক্ত হয়ে পড়লে তাদের ভূমি অ জনজাতিদের কাছে হস্তান্তরযোগ্য হবে। এরকম হলে জনজাতিদের জমি হারানোর পথ পুনরায় খুলে যাবে। জনজাতি সুরক্ষা মঞ্চের এই দাবি জনজাতিদের কাছে আত্মহনণের শামিল হয়ে দাঁড়াবে। উত্তর পূর্বের রাজ্য গুলোর জন্য জনজাতিদের ক্ষেত্রে ষষ্ঠ তপশিলি ভুক্ত আইন প্রণয়ন করা হয়েছে সংবিধানে। বর্তমানে এই আইন প্রণয়নের দাবি উঠছে অন্যান্য রাজ্যের জনজাতি অধ্যুষিত এলাকা গুলোতে। কিন্তু জনজাতিদের খ্রিস্টান স্বীকৃতি বাদ দিয়ে দিলে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে জনজাতিদের সুরক্ষার জন্য গড়ে তোলা সংবিধানের সেই ষষ্ঠ তপশিলি ভুক্ত আইনে। এমনটাই মনে করেন প্রাক্তন বনমন্ত্রী নরেশ জমাতিয়া। এদিন ত্রিপুরার রাজ্য উপজাতি গণমুক্তি পরিষদের কেন্দ্রীয় কমিটির ডাকা সাংবাদিক সম্মেলনে প্রাক্তন বনমন্ত্রী নরেশ জমাতিয়া ছাড়া ও উপস্থিত ছিলেন প্রাক্তন বিধায়ক প্রণব দেববর্মা।