স্যন্দন ডিজিটাল ডেস্ক, আগরতলা,২৮ নভেম্বর: এখানকার পরিবেশ নিয়ে নান্দনিক বর্ণনা দেওয়ার উপায় নেই। সবুজের সমারোহ, সুশীতল ছায়া নেই, যত দূর দৃষ্টি যায়, খা খা মরুভূমি। মূল দোহা থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের ক্লাবটিতে যাওয়ার পথটি আরও বিরাণভূমি!রাস্তার দুই ধারে কিছু ঘর-বাড়ি, কিছু খেজুর গাছের দেখা মেলে, প্রকৃতি বলতে এখানে এতটুকুই। বাড়ির গেটে, দেয়ালে মধ্যপ্রাচ্যের ঐতিহ্যের ছোঁয়া আছে, কিন্তু বৈচিত্র্য নেই, সব কারুকাজ একই ধাঁচের। এখানেই প্রস্তুতি নিচ্ছেন রোনালদো। কিছুটা নীরবে, নিভৃতে।যদিও একটি করে ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপ, নেশন্স লিগের শিরোপা তাদের অর্জনের শোকেসে আলো ছড়াচ্ছে, তারপরও এবারের বিশ্বকাপে ফেভারিটদের তালিকায় নেই পর্তুগাল। হয়তো এ কারণে রোনালদোকে নিয়েও গণমাধ্যমের উচ্ছ্বাসের ঢেউ সুনামির মতো দু-কূল উপচানো নয়। শাহানিয়ার সবুজ আঙিনায় তিনি যখন প্রস্তুতিতে নামলেন, তখন হাতে-গোণা কয়েকজন সংবাদকর্মী উপস্থিত। তাদের মধ্যে যেন ফটোগ্রাফারই বেশি!এসবে অবশ্য কিচ্ছু আসে যায় না রোনালদোর। ‘কারো প্রশংসায় ভেসে যাওয়ার পাত্র নই’, ‘সমালোচনাতেও দমে যাই না’-এই কথাগুলো অনেকবার বলেছেন মাদেইরার সরু গলি থেকে বৈশ্বিক ফুটবলের রাজপথে আধিপত্যের ছড়ি ঘোরানো এই ফরোয়ার্ড। খ্যাতির বিড়ম্বনা নিয়ে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন একান্ত ভাবনা।“আমি সাধারণ একজন মানুষ এবং আর সবার মতো আমারও অনুভূতি আছে। আমাকে নিয়ে অনেক মিথ্যা চাউর হয়…এটাই খ্যাতির বিড়ম্বনা।”২৪ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত শাহানিয়া ক্লাবটির চত্বরে অবশ্য কোনো বিড়ম্বনার মুখোমুখি হতে হচ্ছে না রোনালদোকে। প্রতিটি দলের অনুশীলন ক্যাম্প, কিংবা ট্রেনিং মাঠে নিরাপত্তার ব্যাপক কড়াকড়ি। এর আঙিনায় পর্তুগাল সমর্থকদের ভীড়ও দেখা গেল না। বরং দেখা গেল কখনও ঋষির মগ্নতায়, ফুরফুরে মেজাজে সতীর্থদের সঙ্গে অনুশীলনে ব্যস্ত রোনালদোকে। সামনে যে তার জন্য অপেক্ষা করছে উরুগুয়ে পরীক্ষা।
প্রত্যাশিত জয় নিয়ে কাতার বিশ্বকাপে যাত্রা শুরু রোনালদোর পর্তুগালের। ৩-২ স্কোরলাইনের ম্যাচের সবগুলো গোলই দ্বিতীয়ার্ধে হয়েছিল। যার শুরুটাও রোনালদোর সফল স্পট কিক থেকে। পেনাল্টিতে লক্ষ্যভেদের আনন্দে ডানা মেলার আগে পাঁচবারের বর্ষসেরার চিন্তিত মন, ভেতরের অস্থিরতা, দৃঢ় প্রত্যয়ের অদ্ভূত মিশেল ফুটে উঠেছিল মুখোচ্ছবিতে। প্রস্তুতিতে অবশ্য তার ভিন্ন রূপ।খুব বেশি আমুদে প্রকৃতির, হৈ-হুল্লোড় প্রিয় নন রোনালদো। আন্তর্জাতিক ফুটবলের সর্বোচ্চ গোলদাতা (১১৮টি) মাঠের মতো প্রস্তুতিতেও ধরা দিলেন ‘সিরিয়াস মুডে।’ যদিও গণমাধ্যমের জন্য বরাদ্দ ছিল মাত্র ১৫ মিনিট। এই সময়ে ‘কিপি-আপিতে’, সতীর্থদের সঙ্গে চক্রাকারে দাঁড়িয়ে পাসিং প্র্যাকটিসের ‘চোর-পুলিশ’ খেলাও করলেন গভীর মনোযোগ দিয়ে। ফেলিক্স, লেয়াওদের সঙ্গে সে অর্থে খুনসুঁটি করতে দেখা গেল না তাকে। বরং উরুগুয়ের ম্যাচের করণীয় বোঝাতেই ব্যস্ত তিনি। মাঠের আরেক কোণে কোচ ফের্নান্দো সান্তোস যেন একটু নির্ভার চিত্তে কাজ করলেন বাকিদের সঙ্গে। দলে রোনালদোর মতো গোলমেশিন, নেতা থাকলে একটু চাপমুক্ত থাকাই যায়। পোস্টের নিচে ব্যস্ত সময় কাটালেন গোলরক্ষক দিয়েগো কস্তা, রুই পাত্রিসিওরা। ঘানা ম্যাচে পোস্ট সামলেছেন প্রথম পছন্দের গোলরক্ষক কস্তা। কিন্তু তার দুইবার পরাস্ত হওয়া সান্তোসের জন্য দুর্ভাবনার কারণ বটে। এর মধ্যে একটি একেবারে শেষ মুহূর্তে, ৮৯তম মিনিটে হজম করা।উরুগুয়ের বিপক্ষে পর্তুগালের লড়াই লুসাইলের আঙিনায়; সোমবার বাংলাদেশ সময় রাত ১টায়।‘এইচ’ গ্রুপের টেবিলে ৩ পয়েন্ট নিয়ে শীর্ষে সান্তোসের দল। ১ করে পয়েন্ট উত্তর কোরিয়া ও উরুগুয়ের। লুইস সুয়ারেস, এদিনসন কাভানি, দারউইন নুনেসের মতো অভিজ্ঞ ও তরুণে সাজানো আক্রমণভাগের মুখোমুখি হতে হবে পর্তুগিজদের। পা হড়কালেই বিপদ।অন্যদিকে, স্টেডিয়াম-৯৭৪-এর জয়ের সুবাতাস লুসাইলে বয়ে আনতে পারলে নকআউট পর্ব খেলা নিশ্চিত হবে পর্তুগালের। ৩৭ বছর বয়সে কাতার বিশ্বকাপে আসা রোনালদোর অনেক চাওয়ার একটি পূরণ হবে। গ্রুপ পর্ব পেরিয়ে নকআউট পর্বের চৌকাঠে পা রাখবে পর্তুগাল। হোঁচট খেলেও সুযোগ থাকবে উঠে দাঁড়ানোর, কিন্তু রোনালদোর কী অপেক্ষার সময় আছে?তাই তো অনুশীলনে এতটা সিরিয়াস রোনালদো। নিজেকে নিখুঁত থেকে আরও নিখুঁত করতে তার চেষ্টার কমতি নেই। যে চেষ্টার শুরু হয়েছে সেই শৈশবে এবং চল্লিশের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়েও তা চলছে বিরামহীনভাবে। নিজেকে আরও পরিণত, পরিপূর্ণ করার এই দুনির্বার আকাঙ্ক্ষা এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন রোনালদো।“আমি স্মার্ট কিড, কিন্তু কেউই নিখুঁত নয়…এবং সেটা আমিসহ।”