স্যন্দন ডিজিটাল ডেস্ক, আগরতলা, ২১ অক্টোবর: যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর সমস্যাশঙ্কুল ছয় সপ্তাহ পেরিয়ে শেষমেষ হাল ছেড়ে দিয়ে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন লিজ ট্রাস।তার সরকারের এ সময়টুকু ছিল বিতর্কে ভরপুর। এক সপ্তাহের মধ্যেই তিনি হারিয়েছেন তার গুরুত্বপূর্ণ দুইজন মন্ত্রীকে। তার কর-ছাড় পরিকল্পনার প্রায় পুরোটাই বাদ হয়ে গেছে।ট্রাস অবশ্য তার সরকারের পরিকল্পনা নিয়ে ওঠা নানা প্রশ্ন এবং বিতর্কের জবাবে নিজেকে ‘হাল ছাড়ার পাত্র নন বরং লড়াকু একজন যোদ্ধা’ বলেই দাবি করেছিলেন।কিন্তু তার মধ্যেই বুধবার আরও বৃশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয় পার্লামেন্টে বিরোধীদলের ডাকে হওয়া ফ্র্যাকিং ভোট নিয়ে। এই ভোট নিয়ে আইনপ্রণেতারা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েন।এটি ট্রাসের প্রশাসনের বিষয়ে আস্থা ভোট কিনা তা নিয়ে প্রকাশ্যে তর্কাতর্কিতে জড়িয়ে পড়েন কনজারভেটিভ এমপি’রা। কিছু এমপি প্রকাশ্যে ট্রাসকে পদত্যাগ করার আহ্বানও জানিয়েছিলেন।এরপরই পদত্যাগের ঘোষণা দেন ট্রাস। এর মধ্য দিয়ে যুক্তরাজ্যের ইতিহাসে সবচেয়ে কম সময় প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার রেকর্ড গড়েছেন তিনি।এক নজরে ট্রাসের উত্থান-পতনের সেই সংক্ষিপ্ত পথ পরিক্রমা:
৫ সেপ্টেম্বর:
কর ছাড়ের একটি বলিষ্ঠ পরিকল্পনা, জ্বালানি সংকট সামাল দেওয়া এবং ২০২৪ সালের নির্বাচনে টোরি দলের জয় এনে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষি সুনাককে হারিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন ট্রাস।ট্রাস পেয়েছিলেন ৮১ হাজার ৩২৬ ভোট। আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী ঋষি সুনাক পেয়েছিলেন ৬০ হাজার ৩৯৯ ভোট, যা শতাংশের হিসাবে (৫৭.৪% এবং ৪২.৬%)।তৎকালীন তত্ত্বাববধায়ক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন তিনি। রানি এলিজাবেথের কাছ থেকে পেয়েছিলেন নিয়োগপত্র।
৮ সেপ্টেম্বর
ট্রাস জ্বালনি সংকট সামাল দিতে একটি পরিকল্পনা জানান। বাড়তে থাকা জ্বালানি বিল থেকে জনগণকে রেহাই দিতে তিনি জ্বালানি বিল দু’বছরের জন্য কম রাখার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই সেই পরিকল্পনা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। গরিবদের মতো ধনী পরিবারগুলাকেও তিনি দ্বিগুন আর্থিক সহায়তা কিভাবে দিতে পারেন প্রশ্ন ওঠে তা নিয়ে। তবে সেই প্রশ্নকে পাত্তা দেননি ট্রাস।পরে ওই দিনই রানি এলিজাবেথের মৃত্যু হওয়ায় যুক্তরাজ্যে ১০ দিনের জাতীয় শোক ঘোষণা করা হয়। ফলে সরকারের সব কর্মকাণ্ডই থমকে যায়।
২৩ সেপ্টেম্বর
এদিন ট্রাস ও তার সেই সময়ের অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়ার্টেং ‘মিনি বাজেট’ পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। এতে ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ কর ছাড়ের পাশাপাশি জাতীয় বিমা পরিকল্পনা ও স্ট্যাম্প শুল্কেও ছাড় দেওয়ার কথা বলা হয়। ব্যাপক সরকারি ঋণের মাধ্যমে অর্থায়ন করা এই পরিকল্পনা স্থবির অর্থনীতিতে গতি সঞ্চার করবে বলে প্রথমে তারা আশা প্রকাশ করেন।কিন্তু বাস্তবে ঘটে তার উল্টো ঘটনা। পরিকল্পনাটি সরকারের ব্যাপারে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট তৈরি করে। পাউন্ডের মান এবং সরকারি বন্ডের মূল্য দ্রুত কমতে শুরু করে। ডলারের বিপরীতে পাউন্ডের দাম ইতিহাসে সর্বনিম্ন পর্যায়ে নেমে যায়। যা আন্তর্জাতিক অর্থ বাজারকে এমন মাত্রায় ধাক্কা দেয় যে ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বাজারকে চাঙ্গা করার জন্য ৬৫ বিলিয়ন পাউন্ডের (৭৩ বিলিয়ন ডলার) একটি কর্মসূচী নিয়ে হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হয়।
২৯ সেপ্টেম্বর:
এদিন টোরি সম্মেলনের আগে দিয়ে স্থানীয় বেতারের সাক্ষাৎকারে ট্রাস তার পরিকল্পনা নিয়ে মুখ খোলেন এবং তাতেই অটল থাকেন। অর্থনীতি সচল রাখতে হলে জরুরি ভিত্তিতে ব্যবস্থা নেওয়াটা গুরুত্বপূর্ণ বলেই জোর দেন তিনি।
৩ অক্টোবর:
এদিন আয়করের সর্বোচ্চ হারে ছাড়ের পরিকল্পনা থেকে সরে আসতে বাধ্য হন ট্রাস এবং কোয়াটেং। ৪৫ শতাংশ আয়কর হার বিলোপ করার দিকে তারা আর এগোচ্ছেন না বলে জানান।
১০ অক্টোবর
সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনায় বিনিয়োগকারীদের হারানো আস্থা ফেরানোর চাপের মুখে এদিন কোয়াটেং তার মধ্য-মেয়াদি আর্থিক পরিকল্পনা ও অর্থনৈতিক পূর্বাভাস আগেভাগেই প্রকাশ করবেন বলে জানান। কোয়াটেং ২৩ নভেম্বরের আগে এ পরিকল্পনা প্রকাশ করতে ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু চাপের মুখে তিনি ৩১ অক্টেবরেই তা প্রকাশ করার নিশ্চয়তা দেন।
১২ অক্টোবর
ব্রিটিশ সরকারের ঋণমূল্য ২০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে থাকার খবরের মধ্যেও ট্রাস আবার বলেন, তিনি তার কর- ছাড় কিংবা সরকারের ব্যয় কমানোর পরিকল্পনা বদলাবেন না।
১৪ অক্টোবর
বাড়তে থাকা রাজনৈতিক চাপ এবং বাজার নিয়ে বেসামাল পরিস্থিতির মধ্যে এদিন ট্রাস তার অর্থমন্ত্রী কোয়াসি কোয়াটেংকে বরখাস্ত করেন। যিনি তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং মিত্র বলে পরিচিত।মিনি-বাজেট পরিকল্পনা নিমেষেই অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক বিপর্যয় ডেকে আনার পর প্রধানমন্ত্রী ট্রাস তার গদি বাঁচাতে ছুঁড়ে ফেলেন কোয়াটেংকে। কিন্তু এ পদক্ষেপও কাঙ্খিত ফল বয়ে আনেনি এবং ট্রাসের প্রধানমন্ত্রীত্ব বাঁচাতে যথেষ্ট হয়নি।
১৭ অক্টোবর
ট্রাসের নিয়োগ করা নতুন অর্থমন্ত্রী জেরেমি হান্ট এদিন সরকারের ঘোষিত মিনি-বাজেটে কর ছাড়ের প্রায় সব পরিকল্পনা থেকেই সরে আসেন। হান্টের এই ঘোষণা প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের কর-ছাড় পরিকল্পনার সম্পূর্ণ বিপরীতে যায়। এতে আরও বেশি ঝুঁকিতে পড়ে ট্রাসের রাজনৈতিক অবস্থান।প্রশ্ন ওঠে, যে বাজেট পরিকল্পনার স্বপ্ন দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন ট্রাস, সেটা যদি বাস্তবায়িত না-ই করা যায় তবে তার প্রধানমন্ত্রীর পদে থাকা কতটা যৌক্তিক।দলকে ঐক্যবদ্ধ করতে চরম ব্যর্থ ট্রাস দলের ভেতরে বিদ্রোহের মুখে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তার বিরুদ্ধেই সবচেয়ে সংক্ষিপ্ততম সময়ে এমপিদের অসন্তুষ্টি প্রকাশ এবং তাকে উৎখাতের চেষ্টা করার গুঞ্জন শুরু হয়।
১৮ অক্টোবর
পত্রপত্রিকাগুলো ট্রাসের প্রধানমন্ত্রীত্বের নাজুক এবং অপমানজনক অবস্থা নিয়ে মশকরা শুরু করে। তাকে শেলফে থাকা লেটুসের সঙ্গে তুলনা করা হয় কোনও কোনও পত্রিকায়। আবার ব্রিটিশ ট্যাবলয়েড ডেইলি স্টার মজা করে ‘ট্রাস বনাম লেটুস’ লাইভস্ট্রিম প্রতিযোগিতা ছুড়ে দেয়। লেটুস শুকিয়ে যাওয়ার আগেই ট্রাস প্রধানমন্ত্রীত্ব হারাবেন কিনা- সে প্রশ্ন রাখা হয় পাঠকদের সামনে।ট্রাসের ভঙ্গুর অবস্থানের কথা স্বীকার করে ডেইলি মেইল পত্রিকাও। এমপি’দের ক্ষোভের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে গিয়ে ১৯২২ কমিটির চেয়ারম্যান গ্রাহাম ব্র্যাডি এক বৈঠকে ট্রাসকে সতর্ক করে বলে দেন যে, “তিনি সরকারে আছেন কিন্তু ক্ষমতায় নেই।”
১৯ অক্টোবর:
এদিন বেশ লড়াকু মনোভাব দেখিয়েছিলেন ট্রাস। প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্বে বিরোধীদল লেবারের নেতা কির স্টারমারের এক প্রশ্নের জবাবে ট্রাস দাবি করেছিলেন তিনি একজন “যোদ্ধা, হাল ছাড়ার পাত্র নন’। কিন্তু তিনি এমন দাবি করতে না করতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সুয়েলা ব্রাভারম্যানের পদত্যাগ ট্রাসের অবস্থানকে আরও দুর্বল করে দেয়। ব্রাভারম্যান তার পদত্যাগপত্রে ট্রাসের কিছুটা প্রচ্ছন্ন সমালোচনাও করেছিলেন।
২০ অক্টোবর
এদিন ১৫ জন এমপি প্রকাশ্যেই ট্রাসের পদত্যাগের দাবি জানায়। এরপরই পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়ে একটি বিবৃতি দেন ট্রাস। তার পদত্যাগের ঘোষণা আসতেই “আমাদের লেটুস জিতেছে” বলে ঘোষণা দেয় ট্যাবলয়েড ডেইলি স্টার।