Wednesday, March 19, 2025
বাড়িবিশ্ব সংবাদহিজাব: ইরানি নারী বনাম নীতি পুলিশ

হিজাব: ইরানি নারী বনাম নীতি পুলিশ

স্যন্দন ডিজিটাল ডেস্ক, আগরতলা, ২৪ সেপ্টেম্বর: ইরানের ‘নীতি পুলিশের’ হেফাজতে ২২ বছরের তরুণী মাশা আমিনির মৃত্যু দেশটির কঠোর হিজাব আইন এবং এর বাস্তবায়নকারীদের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে আরও বেগবান করেছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানে নারীর পোশাক নিয়ে কঠোর রক্ষণশীলতার রাষ্ট্রীয় নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়া নারীরা তাদের হিজাব পুড়িয়েও প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। ইরানে ইসলামের আদর্শ ও আইন ঠিকঠাক মেনে চলা হচ্ছে কি না, সেই নজরদারি করছে বিশেষ পুলিশ বাহিনী গাশত-ই-এরশাদ। কারও পোশাক ধর্মীয় নির্দেশনার সঙ্গে ‘অসঙ্গতিপূর্ণ’ হলে তাকে আটক করে এই নীতি পুলিশ। নীতি পুলিশের আছে বিশেষ ক্ষমতা। তারা যে কোনো জায়গায় নারীকে থামিয়ে দেখতে পারবে, তার পোশাকে বা চালচলনে নিয়ম লঙ্ঘন হল কি না। চুল বেশি দেখা যাচ্ছে কি না, সালোয়ার ও কোট বেশি ছোট ও চাপা কি না অথবা তিনি মুখে অতিরিক্ত মেকআপ নিয়েছেন কি না।আইন অমান্য করলে শাস্তির মধ্যে রয়েছে জরিমানা, জেল ও পিটুনি।শরিয়া অনুসারী ইরানের আইনে বলা আছে, নারী তাদের চুল হিজাব দিয়ে ঢেকে রাখবে এবং লম্বা ঝুলের পোশাক পরবে। সেই সঙ্গে পোশাক হতে হবে ঢিলেঢালা, যেন তাদের শরীরের বাঁক স্পষ্ট না হয়ে ওঠে।মাশা আমিনির বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, হিজাব পরে থাকলেও তার কিছু চুল ঠিকই দেখা যাচ্ছিল। গত ১৩ সেপ্টেম্বর এই কারণ দেখিয়েই আটক করা হয় তাকে। কারাগারে নেওয়ার পর তিনি কোমায় চলে যান। তিন দিন পর হাসপাতালে তাকে মৃত ঘোষণা করা হয়। 

পুলিশ কর্মকর্তারা ব্যাটন দিয়ে আমিনির মাথায় আঘাত করেছিলেন এবং তাদের গাড়ির সঙ্গে আমিনির মাথা ঠুকে দিয়েছিলেন বলে অভিযোগ উঠলেও নীতি পুলিশ বাহিনী তা পুরোপুরি অস্বীকার করছে। বিবিসি লিখেছে, ইরানের এক পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে একবার তার অভিজ্ঞতা তাদের জানিয়েছিলেন। “নারীকে সুরক্ষা দিতেই আমরা নীতি পুলিশে কাজ করছি এমনটাই বলা হয়েছিল আমাদের। কারণ নারী যদি ঢেকে রাখা পোশাক না পরে, তাহলে পুরুষ তাতে উত্তেজিত হবে এবং নারীর ক্ষতি করবে।” পরিচয় গোপন রাখা এই পুলিশ বিবিসিকে বলেন, তারা ছয় জনের একটি দলে কাজ করেন; যেখানে চারজন পুরুষ এবং দুজন নারী। ব্যস্ত ফুটপাত আর ভিড়ের দিকেই নজর থাকে তাদের।   “এটি বিব্রতকর, কারণ আমি যদি মানুষকে শুধু নির্দেশনা দিতে যাই, তাহলে কেন ব্যস্ত ভিড় থেকে কাউকে তুলে নিতে হয় আমাদের? “এর অর্থ হল, আমরা আরো অনেককে আটক করতে পারি, তাই না? মনে হয় যেন আমরা শিকার করতে বেরিয়েছি।” ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, তারা যদি নিয়ম ভাঙা ‘যথেষ্ট সংখ্যক’ মানুষ খুঁজে বের করতে না পারেন, তাহলে বিষয়টি তাদের ‘কাজে অবহেলা’ হিসেবে গণ্য করা হবে বলে সব সময় হুঁশিয়ার করতেন তাদের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। বিশেষ করে যখন কাউকে আটক করা হয়, তখকার বিষয়গুলো মেনে নেওয়া ওই পুলিশ কর্মকর্তার কাছে কঠিন ছিল বলে বিবিসিকে তিনি জানিয়েছেন। “বাহিনী থেকে প্রত্যাশা করা হত, আমরা আটকদের জোর করে ভ্যানে তুলে দেব। আপনি জানেন না, এমন করতে গিয়ে আমি কতবার কেঁদেছি। 

“আমি বলতে চাই, আমি আসলে ওদের দলের নই। আমাদের মধ্যে বেশিরভাগই সাধারণ সৈনিক, যাদের বাধ্যতামূলকভাবে বাহিনীতে কাজ করতে হয়। আমার খুব খারাপ লাগে।” প্রায় ৪৩ বছর আগে আয়াতুল্লাহ খোমেনি ফ্রান্সে তার নির্বাসিত জীবন থেকে দেশে ফিরে ইরানে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। সেই বিপ্লবে শাহের রাজত্বের পতন ঘটে, ইসলামি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয় ইরানে। ১৯৭৯ সালের ওই ইসলামি বিপ্লবের পরপরই দেশটিতে হিজাব এবং পোশাকে-আচারে ধর্মীয় নিয়ম লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়। পশ্চিম ঘেঁষা শাহ মোহাম্মদ রেজা পাহলাভিকে সিংহাসনচ্যুত করার আগে তেহরানের সড়কে নারীদের মিনিস্কার্ট ও চুল খোলা অবস্থায় বিচরণ অস্বাভাবিক কিছু ছিল না। ইরানের ওই শেষ সম্রাটের স্ত্রী ফারাহ ছিলেন তখনকার দিনে ‘আধুনিক নারীর উদাহরণ’, তাকে প্রায়ই পশ্চিমা পোশাকে দেখা যেত। নারীর অধিকারকে সুরক্ষা দিতে শাহের আমলে যেসব আইন হয়েছিল, ইরান ইসলামী প্রজাতন্ত্র হওয়ার পর সেগুলো বাতিল করা হয়।

হিজাব আইনের বিরোধিতায় বিক্ষোভ

১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ আয়াতুল্লাহ খোমেনি ঘোষণা করেন, সব নারীর জন্য কর্মক্ষেত্রে হিজাব বাধ্যতামূলক। পর্দা ছাড়া নারীকে ’নগ্ন’ বলে মনে করতেন তিনি।সে সময় তেহরানে হিজাববিরোধী প্রথম বিক্ষোভের আয়োজনে ভূমিকা রেখেছিলেন ৭৮ বছর বয়সী আইনজীবী, অধিকার কর্মী মেহরানগিজ কর।”বিক্ষোভ শুরু হতেই রাজপথে নারী আর পুরুষের ঢল নামে। উপহারের কাগজে মুড়ে থাকার মত হিজাব থেকে নারীকে মুক্তি দেওয়ার দাবি তারা জানিয়েছিলেন।”বর্তমানে ওয়াশিংটন ডিসিতে বাসবাসকারী মেহরানগিজ কর বলেন, সে সময় নারী দিবসে এক লাখের বেশি মানুষ তেহরানের সড়কে জমায়েত হয়েছিলেন, যাদের বেশিরভাগ ছিলেন নারী। খোমেনির ওই ঘোষণার পর ইরানি কর্তৃপক্ষের একটু সময় লেগেছিল নারীর ’যথাযথ’ পোশাক কী হবে তা নির্ধারণ করতে।মেহরানগিজ কর স্মরণ করেন, তখন স্পষ্ট করে কিছু বলা ছিল না। তারপর পোশাক পরা নারীর ছবি অফিসের দেওয়ালে ঝুলিয়ে দেওয়া হল। বলা হল, নারীকে হিজাব পরার ওই নির্দেশ মেনে চলতে হবে। অন্যথায় অফিসে ঢুকতে দেওয়া হবে না। 

নারীর ‘ইসলামী’ পোশাক পরায় আইনি বাধ্যবাধকতা দেওয়া হল ১৯৮১ সালের মধ্যে।চাদাহ বা আপাদমস্তক ঢাকা পোশাকের সঙ্গে মাথাও ঢেকে রাখতে হবে বড় রুমালে। অথবা হিজাব পরতে হবে বাহু ঢেকে রাখা কোটের সঙ্গে।  বাধ্যতামূলক হিজাব পরার এই নিয়মের বিরুদ্ধে তারপরও ব্যক্তি পর্যায়ে আন্দোলন চলছিল বলে জানালেন কর।”আমরা হিজাবে চুল ঢাকার নানা রকম নান্দনিক উপায় বের করেছিলাম, তাতে চুল পুরোপুরি ঢাকা থাকত না। তবে যখন তারা আমাদের বাধা দিত, আমরা প্রতিবাদ করতাম।”১৯৮৩ সালে ইরানের পার্লামেন্টে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়, যে নারীরা জনসমাগমে চুল ঢেকে রাখবে না, তাদের ৭৪ দোররা মেরে শাস্তি দেওয়া হবে। পরে ৬০ দিনের হাজতবাসের শাস্তির বিধানও যোগ করা হয় তার সঙ্গে।তবে বিভিন্ন বয়সী নারীকে প্রায়ই আঁটোসাঁটো পোশাকে দেখা যেত। তারা উরু পর্যন্ত কোট পরে, উজ্জ্বল রঙের হিজাব এমনভাবে পরতেন, যাতে মাথার চুল অনেকটাই দেখা যায়।এসব বন্ধে বিভিন্ন প্রেসিডেন্টের মেয়াদে আইন কঠোর হয়ে উঠছিল, শাস্তির পরিমাণও বাড়ছিল।

তখন তেহরানের মেয়র ছিলেন অতি রক্ষণশীলতায় মাহমুদ আহমাদিনেজাদ। ২০০৪ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার পর টেলিভিশনে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি কিছুটা উদার হওয়ার ইংগিত দিয়ে বলেন, “মানুষের ভিন্ন ভিন্ন রুচি থাকবে। আমরা তাদের সবাইকেই সেবা দিতে চাই।”কিন্তু সে বছর তিনি নির্বাচনে জয়ীয় হওয়ার পরই গঠন করা হয় গাশত-ই-ইরশাদ। এর আগ পর্যন্ত ড্রেস কোড নজরদারিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর অন্যান্য শাখা ও সংসদীয় ইউনিট কাজ করছিল।

নীতি পুলিশ যত কঠোর হয়ে উঠছিল ততই তাদের কর্মকাণ্ড মানুষের সমালোচনার মুখে পড়ছিল।এক সময় নিয়ম ভাঙার অভিযোগে নারীদের ধরে জেলে পুরে দেওয়া শুরু হল। আটক কোনো নারীকে ছেড়ে দেওয়া হত যদি কোনো আত্মীয় এসে ওই নারীর হয়ে যথাযথ পোশাক পরার মুচলেকা দিতেন।২০১৪ সালে ‘মাই স্টিলদি ফ্রিডম’ আন্দোলন করেছিল ইরানের নারীরা। তাতে অংশ নিয়ে হিজাব আইন ভঙ্গ করে তারা ছবি ও ভিডিও পোস্ট করছিলেন। এই আন্দোলন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ‘হোয়াইট ওয়েনেসডেস’ এবং ‘গার্লস অফ রেভোলিউশন স্ট্রিট’ বিক্ষোভও সংঘটিত হয়।  কেন্দ্রীয় শহর ইসপাহানের এক নারী বিবিসিকে বলেন, “ঠোঁটে লিপস্টিক দেওয়ার কারণে আমি ও আমার মেয়েকে পথে আটকানো হয় এবং আমাকে আটক করা হয়।“তারা আমাদের থানায় নিয়ে যায় এবং আমার স্বামীকে আসতে বলে। তিনি আমাদের কখনও হিজাব ছাড়া বাইরে যেতে দেবেন না এই মর্মে কাগজে সই দিতে বলা হয় তাকে।”পায়ে বুট পরার কারণে একজন নারী কর্মকর্তা হুঁশিয়ার করেছিলেন বলে বিবিসিকে জানালেন তেহরানের এক নারী।ওই বুট পুরুষের জন্য ‘অনেক বেশি কামোত্তেজক’– এমন তকমা দিযে আটক করা হয় তাকে। তিনি বলেন, “আমি আমার স্বামীকে ফোন করে তাকে এক জোড়া জুতো নিয়ে আসতে বলি। কাগজে মুচলেকা দিয়ে বলি, যে পোশাক আমি পরেছিলাম, সেটা যথাযথ নয়। আমার নামে এখন ক্রিমিনাল রেকর্ডও আছে।” বিবিসি লিখেছে, নীতি পুলিশের হাতে আটক অনেককে পিটুনি কিংবা আরও ‘নিষ্ঠুর ও অস্বাভাবিক’ শাস্তিও দেওয়া হয়।গায়ে তেলাপোকা ছেড়ে দেওয়া হবে– এমন হুমকি দেওয়া হয়েছিল বলে বিবিসিকে জানিয়েছেন এক নারী।

গত বছর প্রেসিডেন্ট পদে নির্বাচিত হয়েছেন ইব্রাহিম রাইসি। তিনি হাঁটছেন আরও কঠোর রাস্তায়। গত ১৫ অগাস্ট নতুন কিছু বিধিনিষেধ জারির নির্দেশ দিয়েছেনইরানের কোনো নাগরিক যদি হিজাব নিয়ে প্রশ্ন করে, অথবা হিজাব বিরোধী কথা অনলাইনে পোস্ট করে, তাহলেও জেল খাটার নিয়ম রয়েছে সেখানে।এই বিধিনিষেধ আরোপের পর আটকের সংখ্যা বাড়তে থাকে। উল্টোদিকে সোশাল মিডিয়ায় হিজাব ছাড়া ছবি ও ভিডিও দিতে শুরু করে নারীরা। আমিনির মৃত্যু ঘটনা প্রকাশ পেলে তা আরও বেড়ে যায়।মাসিহ আলিনেজাদ একজন সাংবাদিক ও অ্যাকটিভিস্ট, যিনি এখন যুক্তরাষ্ট্রে থাকছেন। তিনি বলেন, আমিনির মৃত্যুর পর থেকে যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে, তা আসলে ব্যক্তির উপলব্ধি থেকে।গত কয়েক বছরে ধরে তিনি হিজাব আইনের বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে আসছেন। ইরানের সরকারসহ অনেকেই তাকে এই চলমান আন্দোলনের পেছনের একজন বলে মনে করছে।ইরানের পশ্চিমের শহর সাকিজে আমিনির শেষকৃত্য অনুষ্ঠানে নারীরা তাদের হিজাব খুলে বাতাসে ওড়াতে থাকেন।এরপর তারা সড়ক দখল করে নেন। অনেককে দেখা যায় আগুন জ্বালিয়ে হিজাব পুড়িয়ে ফেলতে। পুরুষদেরও এতে সমর্থন দিতে দেখা যায়।আলিনেজাদ বলেন, “তাদের এই অংশগ্রহণ আমাকে বার্লিন প্রাচীরের পতনের কথা মনে করিয়ে দিচ্ছিল। আমি আপ্লুত হয়ে উঠছিলাম। আমি আশাবাদী, কারণ এবার মেয়েরা একা নয়। এখন পুরুষও রয়েছে তাদের সঙ্গে।”

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য