Monday, May 19, 2025
বাড়িবিশ্ব সংবাদরাশিয়ায় ভিন্নমত বিপজ্জনক, তবু হাল ছাড়ছেন না রাজনৈতিক কর্মীরা

রাশিয়ায় ভিন্নমত বিপজ্জনক, তবু হাল ছাড়ছেন না রাজনৈতিক কর্মীরা

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক,২৬ ফেব্রুয়ারি: রাশিয়ায় বিরোধীদলীয় নেতা অ্যালেক্সি নাভালনির মৃত্যুর পর আরেক রাজনৈতিক বন্দি কারাগারে থেকেই দেশে পরিবর্তনের আশা জিইয়ে রাখার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।দেশদ্রোহের অভিযোগে সাজা হওয়া বিরোধীদলীয় এই রাজনৈতিক কর্মীর নাম ভ্লাদিমির কারা-মুর্জা। একবার তিনি জেল থেকেই বিবিসি’র পূর্ব-ইউরোপ বিষয়ক সংবাদদাতা সারাহ রেইনসফোর্ডকে লিখেছিলেন, “মুক্তির দাম খুবই চড়া”।কারা-মুর্জা তার রাজনৈতিক মেন্টর বরিস নেমতসভের উদ্ধৃতি দিয়ে কথাটি লিখেছিলেন। ২০১৫ সালে যাকে ক্রেমলিনের কাছে একটি সেতুতে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল।বরিস নেমতসভ উদার রাজনীতিবিদ এবং রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের স্পষ্টবাদী সমালোচক ছিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে তিনি শঙ্কাও প্রকাশ করেছিলেন যে, পুতিন তাকে হত্যা করতে পারেন। তার সে আশঙ্কা সত্য হয়েছিল।

আর এখন মৃত্যু হল প্রেসিডেন্ট পুতিনের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ এবং কট্টর সমালোচক অ্যালেক্সি নাভালনির।আধুনিক রাশিয়ায় আগে কখনও রাজনৈতিক বিরোধিতার মূল্য এমন চড়া ছিল না কিংবা পরিবর্তনের লক্ষ্যও এতটা অধরা ছিল না।প্রতিহিংসার ভয়ও এমন যে, নাভালনির মৃত্যুতে রাশিয়ায় দেখা যায়নি কোনও গণবিক্ষোভ কিংবা বিক্ষুব্ধ প্রতিবাদ। নাভালনির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে সাধারণ মানুষকে বাধা দিয়েছে রুশ কর্তৃপক্ষ। শোক প্রকাশের জন্য কেবল ফুল দিতে গিয়েই অনেকে আটক হয়েছে।

কিন্তু এতকিছুর পরও নাভালনির অসমাপ্ত লড়াই থেকে সরে আসতে নারাজ রাজবন্দি কারা-মুর্জা। নাভালনির আশাও নিভে যেতে না দেওয়ারই পক্ষপাতী তিনি।নাভালনি এবং নেমতসভ একটি মুক্ত রাশিয়ায় বাস করার যে সুযোগের জন্য লড়াই করে গেছেন, সেই লক্ষ্য অর্জনে কারা-মুর্জা এ সপ্তাহে বিরোধীদলের সমর্থকদের ‘আরও কঠোর পরিশ্রম’ করার আহ্বান জানিয়েছেন।কারা-মুর্জা অনেক আগেই নিজের জন্য এ পথ বেছে নিয়েছিলেন। ২০২২ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পরপরই তিনি বিবিসি সংবাদদাতাকে লিখেছিলেন, “কথা বলার মূল্য চড়া। কিন্তু নীরবতার মূল্য মেনে নেওয়া যায় না।”

শক্ত মানুষ

৪৭ বছর বয়স্ক অ্যালেক্সি নাভালনি এবং ৪২ বছর বয়সী ভ্লাদিমির কারা-মুর্জা দু’জনই খুবই ভিন্ন ধাঁচের মানুষ।নাভালনি ছিলেন ক্যারিশমাটিক বক্তা। কারাগারে থাকার সময়ও তার কথার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তিনি ব্লগার ছিলেন। সরকার বিরোধী বিক্ষোভ সংগঠিত করেছিলেন।রাশিয়ায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে, পুতিন ও তার সরকারের বিরুদ্ধে সংস্কারের পক্ষে কথা বলেছিলেন। দুর্নীতিবিরোধী ফাউন্ডেশনের (এফবিকে) প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন নাভালনি।

অন্যদিকে কারা-মুর্জা নম্র ভাষায় কথা বলা বুদ্ধিজীবী। রাশিয়া ও ব্রিটেনের দ্বৈত নাগরিকত্ব থাকা কারা-মুর্জা ক্রেমলিনের সবচেয়ে সোচ্চার সমালোচক। যদিও রাশিয়ার জনগণের কাছে তার নাম এখনও অতটা সুপরিচিত নয়।কিন্তু তারপরও চিন্তা-চেতনায় দুইজনেরই মিল ছিল এবং তাদের দৃঢ়বিশ্বাসও এই যে, রাশিয়া চিরস্থায়ী নয়। সেখানে রাজনৈতিক স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা পাওয়া সম্ভব।নাভালনি যেখানে রাশিয়ার ক্ষমতার উচ্চ পর্যায়ের দুর্নীতি ভিডিওতে প্রকাশ করে দিতেন, সেখানে কারা-মুর্জা বিদেশে এইসব দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের সম্পদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ার জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর সরকারের সঙ্গে লবি করতেন।দুইজনকেই এর জন্য চড়া মূল্য দিতে হয়েছে। নাভালনি যেমন বিষপ্রয়োগের শিকার (নার্ভ এজেন্ট হামলা) হয়েছিলেন তেমন হয়েছেন কারা-মুর্জাও।

বিষপ্রয়োগের শিকার হওয়ার পর কারা-মুর্জা ২০১৫ সালে কোমায় চলে গিয়েছিলেন। নাভালনি নার্ভ এজেন্ট হামলার শিকার হওয়ার পাঁচবছর আগে এ ঘটনা ঘটে।কেবল একবারই নয়, দু’বার বিষপ্রয়োগ করা হয়েছিল কারা-মুর্জাকে। দ্বিতীয়বারের সময় যুক্তরাষ্ট্রে ডাক্তারি পরীক্ষায় তিনি যে বিষপ্রয়োগের শিকার তা নিশ্চিত হয়।ইউক্রেইন যুদ্ধের নিন্দা করার জন্য মুর্জাকে তাকে জেলে যেতে হয়েছে। ২০২২ সালে অ্যারিজোনার প্রতিনিধি পরিষদে তিনি ইউক্রেইনে রাশিয়ার আগ্রাসনের নিন্দা করার পর সেবছরই গ্রেপ্তার হন। পরে তার ২৫ বছরের জেল হয়। কিন্তু মুর্জা তার মত প্রকাশ কখনও বন্ধ করেননি।

রাশিয়ায় প্রত্যাবর্তন

অ্যালেক্সি নাভালনি হত্যাচেষ্টার শিকার হওয়ার পর ২০২১ সালে যখন রাশিয়ায় ফেরার পথ বেছে নিলেন, তখন কেউ কেউ তাকে বোকাই মনে করেছিলেন।বিরোধীদলীয় যেসব রাজনীতিবিদ দেশে বিরোধিতা করে জেলে যাওয়ার চাইতে বিদেশে নির্বাসনে থাকার পথ বেছে নিয়েছেন, তাদের যুক্তি ছিল- পরিবর্তনের কোনও সম্ভাবনা দেখা না গেলে ত্যাগ স্বীকার করা নিরর্থক।কিন্তু নাভালনি এভাবে চিন্তা করেননি। ১৬ ফেব্রুয়ারিতে মারা যাওয়ার আগে তিনি লিখেছিলেন, “যদি সত্যিই আপনার বিশ্বাসের কিছু মূল্য থেকে থাকে, আপনাকে সেজন্য লড়ে যেতে প্রস্তুত থাকতে হবে। আর দরকার পড়লে ত্যাগও করতে হবে।”নাভালনির মতো করে ভাবেন কারা-মুর্জাও। তারও বউ আছে। সন্তান আছে। যুক্তরাষ্ট্র-যুক্তরাজ্যের পাসপোর্ট আছে। তবুও তিনি রাশিয়ায় ফিরতে কখনও দ্বিধা করেননি।

২০২২ সালে কারাগার থেকে তিনি লেখেন, “আমি যদি নিরাপদে অন্য কোথাও গিয়ে বসে থাকি তাহলে আমার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাওয়া, অন্য মানুষজনকে একাজে নামার আহ্বান জানানোর কোনও অধিকার আছে বলে আমি মনে করি না।ফলে নাভালনি এবং কারা-মুর্জা দুইজনই এই ত্যাগ করেছেন বিবেকের তাড়নায়। এখন একজন মারা গেছেন। আর একজন পরিবার থেকে বহুদূরে কারাগারে বন্দি। ছয়মাসে তাকে একবার মাত্র ফোনকল করতে দেওয়া হয়।সেই ফোনকলে বাবাকে সন্তানদের সঙ্গে কথা বলতে দেওয়ার জন্য কারা-মুর্জার স্ত্রী ইভগেনিয়া নিজেই তার স্বামীর সঙ্গে কথা বলেননি। বরং পাঁচ মিনিট করে তিন সন্তানকে কথা বলতে দিয়েছেন। আর পাশে দাঁড়িয়ে থেকেছেন টাইমার নিয়ে।

শক্ত নারী

অ্যালেক্সি নাভালনি রাশিয়ার মুক্তির জন্য যে লড়াই করে আসছিলেন, তা চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেছেন তার বিধবা স্ত্রী ইউলিয়া নাভালনায়া। এ সপ্তাহে একটি ভিডিও প্রকাশ করে ইউলিয়া সমর্থকদেরকে লড়াইয়ে ক্ষ্যান্ত না দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।তিনি বলেছেন, “আমি মুক্ত একটি রাশিয়ায় বাস করতে চাই। মুক্ত রাশিয়া গড়ে তুলতে চাই।” ইউলিয়া এর আগে রাজনীতিতে আগ্রহী নন বললেও এখন নাভালনি মারা যাওয়ার পর প্রকাশ করা ভিডিও বার্তায় তিনি এ অবস্থান পরিবর্তন করার বার্তা দিয়েছেন।

ইউলিয়ার এই সাহস দেখে হতবাক হয়েছেন কারা-মুর্জার স্ত্রী। বলেছেন, “তিনি (ইউলিয়া) নরকের মধ্য দিয়ে যেতে মাথা উঁচু করে নিজের সর্বশ্রেষ্ঠ কাজটিই করছেন।”তবে কারা-মুর্জার স্ত্রী ইভগেনিয়া নিজেও বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছেন। তার স্বামী গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকেই তিনি বিশ্বব্যাপী সফর করে বেড়াচ্ছেন। পশ্চিমা কর্মকর্তাদের সঙ্গে লবি করছেন। স্বামী ও অন্যান্য রাজবন্দিদের মুক্তির জন্য তাদের সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করছেন।ইভগেনিয়া বলেন, “আমি চাই তারা (পশ্চিমা নেতারা) তাকে (কারা-মুর্জা) কারামুক্ত করতে আরও চাপ প্রয়োগ করুক। আমি তার যথাযথ চিকিৎসা ব্যবস্থারও দাবি জানাচ্ছি।”“কিন্তু আজকাল কোনও সরকারকে তার নাগরিকের জন্য মনোযোগী করা কঠিন।”

জেলে নিপীড়ন

কারা-মুর্জকে জেলে নির্যাতন করা হচ্ছে। যেমন করা হয়েছিল নাভালনিকেও। কারা-মুর্জাকে নির্জন কারাকক্ষে রাখা হয়েছে মাসের পর মাস। তার নিজস্ব জিনিসপত্র বলতে কিছু নেই। তার সন্তানদের ছবিও নেই।জানুয়ারিতে তাকে নতুন কারাগারে নেওয়া হয়। সেখানে আরও কঠোর নিয়মকানুন। বই পড়ারও কোনও সুযোগ নেই। বিষপ্রয়োগের শিকার হওয়ার কারণে তার স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয়েছে। স্বাস্থ্য আরও খারাপ হচ্ছে। নাভালনির মৃত্যুর পর মুর্জার মুক্তির জন্য চাপ আরও তীব্র হয়েছে।বিবিসি সংবাদদাতাকে মুর্জার স্ত্রী বলেছেন, তার স্বামীর নার্ভের যে ক্ষতি হয়েছিল তা এখন দেহের ডানদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। অবস্থা মারাত্মক। তিনি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়তে পারেন।

কিন্তু এত শোচনীয় অবস্থাতে থাকার পরও কারা-মুুর্জার মনোবল যেন আগের যে কোনও সময়ের চেয়ে আরও দৃঢ় হয়েছে। এ সপ্তাহে মস্কোর আদালতে একটি ভিডিও লিংকে তাকে দেখা যাওয়ার পর সেরকমই মনে হয়েছে। রাশিয়ার নাগরিকদেরকে হতাশায় মুষড়ে না পড়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।আদালতে উপস্থিত গুটিকতক সমর্থক এবং সাংবাদিকের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে তিনি বলেন, “রাশিয়া মুক্ত হবে। ভবিষ্যৎকে কেউ ঠেকাতে পারবে না।”নাভালনির মৃত্যুর পর দেশে দেশে গণজাগরণ হয়েছে। অনেকেই পুতিনকে দায়ী করেছেন। ছবি: বিবিসি থেকে নেওয়া।

কী ভবিষ্যৎ?

কারা-মুর্জার স্ত্রী আদালতে স্বামীর সেই ভিডিও ক্লিপ দেখেছেন হাজারবার। বলেছেন, “আমি মনে করি তিনি ঠিক কাজটাই করছেন। মহান কাজ করছেন।”“মানুষ ভগ্নহৃদয়, হতাশা বোধ করছে। এমন সময়ে সেইসব মানুষ যারা কোনও চাপ কিংবা ভয়ভীতিতে দমে যায় না, তাদের কাছ থেকে এমন উচ্চকিত কণ্ঠের আহ্বান সত্যিই গুরুত্বপূর্ণ। আমি মুর্জার জন্য খুবই গর্ববোধ করি এই নরকের মধ্যে থেকেও নিজের কাছে তার সৎ থাকার জন্য।”

রাশিয়ার বহু রাজনৈতিক কর্মীই জেলে কিংবা নির্বাসনে আছে। এ পরিস্থিতিতে এখন পর্যন্ত স্বামীর মনোবল এবং বিশ্বাসের কথা তুলে ধরে ইভগেনিয়া বলেন, “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে মানুষ হয়ে থাকা এবং যা কিছু করা সম্ভব করার চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া। ক্ষ্যান্ত না দেওয়া।”সোভিয়েত রাশিয়ার অবসান এবং সেইসময়কার গণবিক্ষোভের কথা উল্লেখ করে ইভগেনিয়া বলেন, তার স্বামীকে সেই দিনগুলোই সবসময় উদ্দীপনা যুগিয়েছে।“১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশকের শেষদিকে সবার সম্মিলিত জাগরণের অনুকূল সময় না আসা পর্যন্ত কিছুই হয়নি। শাসকগোষ্ঠীতে ফাটল দেখা দেওয়ার সেই মুহূর্তটির জন্য, কখন আমাদের সেই সুযোগ আসবে সেজন্য প্রস্তুত থাকতে আমাদের যথাসম্ভব সবকিছুই করা দরকার,” বলেন ইভগেনিয়া।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য

error: <b>Alert: </b>Content selection is disabled!!