Wednesday, March 19, 2025
বাড়িখেলাধৈর্য হারালে শিখতে পারেন লুনিনকে দেখে

ধৈর্য হারালে শিখতে পারেন লুনিনকে দেখে

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ১৮ এপ্রিল: কবি ও সুফি দার্শনিক জালালউদ্দিন রুমি ধৈর্য নিয়ে দারুণ একটা কথা বলে গেছেন, ‘ধৈর্য মানে শুধু বসে অপেক্ষা করা নয়, ধৈর্য মানে ভবিষ্যৎকে দেখতে পাওয়া। ধৈর্য মানে কাঁটার দিকে তাকিয়েও গোলাপকে দেখা। দিনের আলোকে দেখা রাতের অন্ধকারে তাকিয়েও।’ইউক্রেনের ক্লাব জরিয়া লুহানস্ক থেকে আন্দ্রি লুনিন রিয়াল মাদ্রিদে যোগ দিয়েছেন ২০১৮ সালে। প্রথম কিংবা দ্বিতীয়ও নয়, কোচের পছন্দের তালিকায় তৃতীয় গোলকিপার ছিলেন লুনিন। রিয়াল তাঁকে এর মধ্যে তিনবার ধারেও পাঠিয়েছে তিনটি ক্লাবে—লেগানেস, ভায়াদোলিদ ও ওভিয়েদোয়। শুধু তাই নয়, চলতি মৌসুমের শুরুতেও আনচেলত্তির পছন্দের তালিকায় তৃতীয় গোলকিপার ছিলেন লুনিন। পছন্দের তালিকায় যিনি প্রথম, সেই থিবো কোর্তোয়া এসিএল চোটে পড়েছিলেন গত বছর আগস্টে। লুনিন থাকলেও সেই আগস্টেই কোর্তোয়ার বিকল্প হিসেবে কেপা আরিজাবালাগাকে ধারে উড়িয়ে আনে রিয়াল।

কিন্তু লুনিন হাল ছাড়েননি। স্বপ্ন দেখাও বাদ দেননি। ধৈর্য-পরিশ্রম-অধ্যবসায়ের সম্মিলনে শুধু নিজের কাজটা করে গেছেন। তৃতীয় পছন্দের গোলকিপার হওয়ার ‘কাঁটা’ হজম করে তাকিয়েছেন ভবিষ্যতে ফুটতে থাকা একটি গোলাপের পানে। গতকাল রাতে সেই ‘গোলাপ’টাই ফুটল ইতিহাদে!ম্যাচের ফল এতক্ষণে সবার জানা। লুনিন কী করেছেন সেটাও। কোয়ার্টার ফাইনালের প্রথম লেগ ৩-৩ গোলে ড্রয়ের পর ম্যানচেস্টার সিটির মাঠ ইতিহাদে ফিরতি লেগ অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত ১-১ গোলে ড্র। তারপর হলো টাইব্রেকার নামের স্নায়ু পরীক্ষা। যেটা আবার গোলকিপারদের জন্য কখনো বধ্যভূমি, কখনো-বা মাথা তুলে দাঁড়ানোর মঞ্চ। লুনিন হয়েছেন পরেরটি।

টাইব্রেকারে মাতেও কোভাচিচ এবং বের্নার্দো সিলভার শট ঠেকিয়েছেন। তার আগে ম্যাচের অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত করেছেন ৮টি সেভ। এতেও ‘অতি অল্প হইলে’ তাকাতে পারেন শেষ ষোলোর মঞ্চে। লাইপজিগের বিপক্ষে সেই মঞ্চে তো গড়েছেন রেকর্ড—৯টি সেভ!কিন্তু ইউক্রেনের ২৫ বছর বয়সী এ গোলকিপার সম্ভবত একটু অন্য ধাতে গড়া মানুষ। ইতিহাদে গতকাল রাতে টাইব্রেকারে আন্তনি রুডিগারের গোল করার পরের মুহূর্তটি একবার মনে করুন। রুডিগার গোল করে রিয়ালকে জেতানোর আনন্দে যখন দৌড় দিলেন, লুনিন তখন ডান প্রান্তে বক্সের বাইরে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়িয়ে। ধীরে ধীরে হাঁটতে শুরু করলেন, যেন কিছুই হয়নি! তাঁর সতীর্থরা দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। লুনিন তখনো স্বাভাবিক।

এর কারণ হতে পারে মুদ্রার উল্টো পিঠটাও দেখে আসায়। তৃতীয় পছন্দ হওয়ার ‘কাঁটা’র আঘাত কিংবা সে আঘাতে চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসা—সেসব পেরিয়ে গতকাল রাতে লুনিন যখন আলোর দেখা পেলেন কিংবা রিয়ালকে সেমিফাইনাল-আলোর দেখা পাইয়ে দিলেন, তখন আপনি ধৈর্যকে ধন্যবাদ জানাতেই পারেন। ঠাস করে একটা স্যালুট ঠুকতে পারেন পরিশ্রম নামের বেদিতে। কেন? তবে একটা গল্প শুনুন—রিয়াল ওভিয়েদোর তখনকার গোলকিপারদের কোচ সের্হিও সেগুরা বলেছেন লুনিনের সেই গল্প। ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি থেকে ৩০ জুন পর্যন্ত লুনিনকে ধারে পেয়েছিল স্প্যানিশ ফুটবলের দ্বিতীয় স্তরে খেলা ক্লাবটি। তখন চুপচাপ শান্তশিষ্ট লুনিন কী করতেন শুনুন সেগুরার মুখেই, ‘সে একদম ছোট্ট একটা ফ্ল্যাটে থাকত। বড়জোর ৪৮৪ বর্গফুট আয়তন হবে। কোভিড মহামারি শুরুর পর সে প্রতিদিন লিভিং রুমের সব আসবাবপত্র বের করে বাইরে রাখত। এরপর মেঝেতে একটি অ্যাস্ট্রোটার্ফ পেতে সেখানেই অনুশীলন করত।’

ওভিয়েদো থেকে ৬ মাইল দূরের শহর লুগো দে লালানেরায় থাকতেন লুনিন। মাত্র ৩ হাজার জনবসতির সেই শহরে প্রায় সবাই সবাইকে চিনতেন। লুনিনকেও চিনতেন প্রায় সবাই। যতই ধারে আসুক, রিয়াল মাদ্রিদের গোলকিপার বলে কথা! কিন্তু মাঠের বাইরে লুনিনের আচরণে কখনো তা প্রকাশ পায়নি। অনেকটাই গতকাল রাতে রিয়ালের জয় নিশ্চিত হওয়ার পর সেই নির্বিকার ভাবলেশহীন হাঁটার মতোই জীবনযাপন করেছেন লুগো দে লালানেরায়। আসলে ভেতরে ভেতরে নিজেকে প্রস্তুত করেছেন। কিসের জন্য, কোন দিনটির জন্য, সেটা এতক্ষণে আপনার জানা।ধৈর্যে মজে লুনিনের সে প্রস্তুতির গল্পই বলেছেন সেগুরা, ‘অনুশীলনের সরঞ্জাম তার কাছে সব সময় থাকতই। ট্রেনিং ভেস্ট, বরফভর্তি ব্যাগ, সে শতভাগ দিয়েছে সব সময়। শুধু অনুশীলন, অনুশীলন আর অনুশীলন। নিজেকে একদম নিংড়ে দিয়েছে। এখানে (ওভিয়েদো) আসার পর সে শুধু একটা সুযোগই চেয়েছে—প্রতিদিন যেন অনুশীলন করতে পারে। অন্তত এই ব্যাপারটায় যেন কোনো সমস্যা না হয়।’

শুধু কী তাই? লেগানেস ও ভায়াদোলিদেও লুনিনের গল্পটা একই। অনুশীলন করে সবাই যখন চলে গেছেন, লেগানেসের অনুশীলন গ্রাউন্ডের ফটকও বন্ধ হয়েছে—লুনিন তখন লুকিয়ে অনুশীলন মাঠে ঢুকে নিজের প্রস্তুতিতে অতিরিক্ত শানটুকু দিয়েছেন। অথচ লেগানেসের হয়ে খেলেছেন মাত্র ৭ ম্যাচ, ভায়াদোলিদে আরও কম—২ ম্যাচ। ওভিয়েদো তাঁকে খেলিয়েছে ২০ ম্যাচ। আসলে ওখানেই তৈরি করেছেন নিজেকে। লুনিনের যে বিষয়টি সেগুরার সবচেয়ে ভালো লেগেছে সেটি হলো তাঁর ‘শীতল রক্ত’—মানে মাথা ঠান্ডা রাখার ক্ষমতা, ‘তখন সে বয়সে একদম তরুণ। বাজে একটি গোল হজম করলে কিংবা ভুল বোঝাবুঝিতে গোল খেলে সে এমন ভাব করত যেন কিছুই হয়নি। ভেতরে ভেতরে হয়তো অতটা শান্ত ছিল না। কিন্তু বাইরের চাপটা সে খুব ভালোভাবে শুষে নিতে পারে।’

সেগুরা আরও একটি বিষয় জানিয়েছেন লুনিনের ব্যাপারে, ‘সে ভীষণ সৎ-ও। নিজের চাওয়ার ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা ছিল। সে এখানে এসে অনুশীলন করে ম্যাচ খেলে নিজেকে প্রস্তুত করে মাদ্রিদে ফিরতে চেয়েছে।’মাদ্রিদে ফিরে সেই লুনিন এখন ধীরে ধীরে রিয়ালের নাম্বার ওয়ান গোলকিপার। সেগুরার ভাষায়, ‘জায়গাটা কেউ তাকে উপহার দেয়নি। বিশ্বের সেরা গোলকিপারের সতীর্থ হলে খেলাটা সহজ নয়। কোর্তোয়া চোট পেয়েছিল, এরপর ওরা (রিয়াল) কেপাকে আনল, তাতে লুনিনের অপেক্ষাও বাড়ল। লোকে বলত সে বিকল্প গোলকিপার। দলটা রিয়াল মাদ্রিদ, সেখানে আপনি খেলার সুযোগ না-ই পেতে পারেন, কিন্তু ওরা আপনাকে রাখার অর্থ হলো, আপনি সত্যিই নিজের কাজে ভালো।’ সেগুরা মনে করেন, লুনিন সেই সময় ধৈর্য ধরে রিয়ালে থেকে যাওয়ার পুরস্কারটাই এখন পাচ্ছেন। গতকাল রাতের ম্যাচের পর সেগুরাকে একই প্রশ্ন করলে তিনি হয়তো উত্তরটা পাল্টাতেও পারেন—লুনিন আসলে রিয়ালকেই পুরস্কৃত করেছেন!

কিন্তু এই যে এতসব স্তুতিবাক্য আর প্রশংসার মালা—রিয়ালকে সেমিফাইনালে তোলার লুনিনের নিজের কেমন লাগছে? ইতিহাদে শেষ বাঁশি বাজার পর ‘মুভিস্টার’কে যা বলেছেন, সেসব শুনলে মনে হয় ৬ ফুট ৩ ইঞ্চি উচ্চতার লোকটা আসলেই একটু অন্য ধাতে গড়া, ‘খুব ক্লান্ত লাগছে। ক্যারিয়ারে এমন ম্যাচ এই প্রথম। প্রচণ্ড প্রত্যাশার চাপের মধ্যে ১২০ মিনিট খেলতে হলো। সেটাও চ্যাম্পিয়নস লিগে প্রতিপক্ষের মাঠে। দলকে ধন্যবাদ। আমরা ভুগেছি, লড়েছি এবং শেষ পর্যন্ত সেমিফাইনালে উঠেছি।’অতিরিক্ত কোনো উচ্ছ্বাস নেই। কিছুটা বোকা বোকা সরল কিন্তু সত্যি কথা!ওহ, লুনিন আরেকটি কথাও বলেছেন, ‘আমি পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ।’ কারণটা আপনার জানা। তবে অজানা কথাটাও জানিয়ে রাখা ভালো—ধৈর্য মানে কাঁটার দিকে তাকিয়ে গোলাপকে দেখা এবং শেষ পর্যন্ত সেটি পাওয়াও। কাল ম্যাচসেরার পুরস্কার উঠেছে ফেদে ভালর্ভেদের হাতে। আর লুনিন পেয়েছেন সেই ‘গোলাপ’টি। দিয়েছেন রিয়াল সমর্থকেরাই।

বিশ্বাস হচ্ছে না?

গতকাল রাতের ম্যাচটি দেখা যেকোনো রিয়াল সমর্থককে গিয়ে জিজ্ঞেস করতে পারেন। লুনিনের হাতে গোলাপ তুলে দিক বা না দিক, বলতে বাধ্য — ‘একটা গোলাপ তোমার নামে, পাঠিয়ে দিলাম মনের খামে!

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য