স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক ,১৫ ডিসেম্বর: আল বাইত স্টেডিয়ামে কাতার বিশ্বকাপের দ্বিতীয় সেমি-ফাইনালে ফ্রান্সের বিপক্ষে ২-০ গোলে হেরে রূপকথার পথচলা ‘থেমেছে’ মরক্কোর। কিন্তু এ যেন শেষ নয় মোটেও, নতুনের আগমণী বার্তা ‘শির, শির’ গর্জনে প্রবলভাবে দিয়ে গেল উত্তর আফ্রিকার দেশটি। মরুভূমির বিশ্বকাপ এবার মাতিয়ে রাখে অংশ নেওয়া ৩২টি দেশ তো বটেই, বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আসা ফুটবলপ্রেমীরাও। ‘ওলে, ওলে, ওলে’, ‘ভামোস আর্জেন্টিনা, ভামোস আর্জেন্টিনা’, ‘মেক্সিকানো, মেক্সিকানো’ কিংবা ‘ইউ-এস-এ, ইউ-এস-এ’ কোরাসে মুখরিত হয়েছে গ্যালারি। আরও কত রকমারি সুর, রাগের ছড়াছড়ি, তার ইয়ত্তা নেই। কিন্তু মরক্কোর ‘শির-শির’ গর্জন একেবারেই আলাদা।কাতার বিশ্বকাপের অবিশ্বাস্য পথচলায় দলটির সমর্থকরা সারাক্ষণই গ্যালারি মাতানোর চেয়ে বরং বলা ভালো কাঁপন তুলেছেন এই ‘শির-শির’ স্লোগানে। ফ্রান্স ম্যাচেও রেফারির কিক-অফের বাঁশি বাজতে শুরু ‘শির-শির’ উদ্দাম ধ্বনি। শুরুতে একটু ধীরলয়ে, এরপর সময় যত গড়ায় ‘র’-বর্ণটি যেন বিলুপ্ত হয়, ‘শি-শি’ শব্দ শিষ দেওয়ার মতো শোনায়।
শুরুতে কানের কাছে গুণগুণিয়ে বাজতে থাকা কোরাসের সুর ‘বড় যন্ত্রণার’ কারণ হয়ে দাঁড়ায় হাকিমিদের পায়ে বল গেলেই। ২০১০ সালের দক্ষিণ আফ্রিকা বিশ্বকাপে সবার যন্ত্রণার কারণ হয়ে দাঁড়ানো ভুভুজেলা বাশিঁর বেসুরো ভো-ভো শব্দের চেয়েও এর ঝাঁঝ বেশি। রীতিমতো কান-মাথা ধরে আসে। সিংহের গর্জন-বোধহয় একেই বলে। যদিও এই ‘শির-শির’ শব্দের অর্থ একেবারেই ভিন্ন-এগিয়ে যাও, এগিয়ে যাও।সমর্থকদের এই কোরাসের সুরে সুর মিলিয়ে গ্রুপ পর্ব থেকে আলো ছড়িয়ে এগিয়ে যায় মরক্কোও, যাদের কেউ হয়তো শুরুতে গোণায় ধরেনি। কিন্তু উত্তর আফ্রিকার দেশটিই ‘এফ’ গ্রুপের সেরা দল হয়ে উঠে আসে নকআউট পর্বে; তিন ম্যাচে দুই জয় ও এক ড্রয়ে ৭ পয়েন্ট পাওয়ার তৃপ্তি নিয়ে।শেষ ষোলোয় তাদের প্রতিপক্ষ স্পেন। ২০১০ সালের চ্যাম্পিয়নদের পাল্লাই ছিল ভারি। কিন্তু পাশার দান মরক্কো উল্টে দেয় টাইব্রেকারে ৩-০ গোলে জিতে! কোয়ার্টার-ফাইনালে ক্রিস্তিয়ানো রোনালদোর পর্তুগালকে স্তব্ধ করে দেন আশরাফ হাকিমি-হাকিম জিয়াশরা। ১-০ গোলের জয়ে ইতিহাস লেখা হয়ে যায় মরক্কোর। আফ্রিকার প্রথম দল হিসেবে বিশ্বকাপের সেমি-ফাইনালের মঞ্চে ওঠার ঈর্ষণীয় কীর্তি গড়া দল তারাই।মরক্কোর ওই জয় আফ্রিকা এবং আরবের অলিগলিতে উচ্ছ্বাসের বন্যা বইয়ে দেয়। ওয়ালিদ রেগরাগির দল ভাসতে থাকে প্রশংসার স্রোতে, অভিনন্দনের বার্তায়। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ফরাসি শাসনে থাকায় খোদ ফ্রান্সেও মরক্কোর অধিবাসী কম নয়। প্যারিসের রাস্তায় তারাও বাঁধনহারা উল্লাসে মেতে ওঠে। সেখানে জুটে যায় ফরাসি সমর্থকরাও। দুই সমর্থকদের সঙ্গে ফরাসি পুলিশের সংঘর্ষের খবরও আসে গণমাধ্যমে।
বাইত স্টেডিয়ামের আঙিনায় দ্বিতীয় সেমি-ফাইনাল ছিল ফরাসি সৌরভ বনাম এটলাস লায়ন্সের। মাঠে সৌরভ ছড়িয়ে ফাইনালের মঞ্চে উঠেছে দিদিয়ের দেশমের ফ্রান্স। ঝরে পড়া দলের তালিকায় নাম উঠেছে মরক্কোর, কিন্তু ‘শির-শির’ গর্জন সত্ত্বেও ছাপ রেখে গেল ফুটবলপ্রেমীদের হৃদয়ে।বিশ্বকাপের প্রতিটি আসরে কেউ ইউরোপের পতাকা ওড়ায়, কেউ লাতিনের, কেউ এশিয়া কিংবা আফ্রিকার। কিন্তু কাতার বিশ্বকাপে মরক্কো যেন ভিন্ন এক বার্তাই দিয়ে গেল। বিশ্বের মানচিত্রে উত্তর আফ্রিকার দেশ হলেও এটি কেবল শুধু আফ্রিকার নয়, আরব দেশ বলে তারা মধ্যপ্রাচ্যেরও অবিচ্ছেদ্য অংশ।সীমান্ত বিচ্ছেদ টেনে দিয়েছে বটে, কিন্তু ফরাসিদের সঙ্গে বন্ধন টুটে যায়নি আজও। তাই প্যারিসের রাস্তায় হয় মরক্কোকে নিয়ে আনন্দ মিছিল, তাও আবার ফ্রান্সের বিপক্ষে সেমি-ফাইনালের মহারণের আগে!আর্জেন্টিনা, ব্রাজিলের জয়ের আনন্দে মধ্যপ্রাচ্যে, এশিয়ার অলি-গলি মুখরিত হয়, উচ্ছ্বাসের ঢেউ বয়ে যায়। কিন্তু মরক্কো সেই ঢেউ বইয়ে দেবে, কে ভেবেছিল? ফুটবলের ‘এক হয়ে ওঠা’র সুরের দ্যোতনা মহাদেশের সীমানা পেরিয়ে চারদিকে ছড়িয়ে দিল তারা। যেন বৈশ্বিক ফুটবলে পেছনের বেঞ্চে থাকা দেশগুলোর প্রতিনিধিও মরক্কো হয়ে গেল এবার!