স্যন্দন ডিজিটাল ডেস্ক, আগরতলা, ৫ ডিসেম্বর: চার বছর আগেই তিনি পেয়েছেন বিশ্বকাপ জয়ের অবিস্মরণীয় স্বাদ। রাশিয়া আসরে গোলের আনন্দে ডানা মেলেছিলেন চারবার। আর এবার চার ম্যাচেই জালের দেখা পেয়েছেন ৫ বার। চলতি বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় সৌরভ ছড়ানো এই ফরাসি ফরোয়ার্ডের ধারেকাছে নেই কেউ।তিনটি করে গোল নিয়ে এ তালিকায় পরের সারিতে আছে মোট সাত জন; এর মধ্যে আছেন তারই পিএসজি সতীর্থ লিওনেল মেসির মতো মহাতারকা। আছেন মার্কাশ র্যাশফোর্ড, অলিভিয়ে জিরুদ, আলভারো মোরাতা, বুকায়ো সাকো ও কোডি হাকপো। তিন গোল আছে এন্নের ভালেন্সিয়ারও, কিন্তু একুয়েডর গ্রুপ পর্ব থেকে ছিটকে যাওয়ায় তার এগিয়ে যাওয়ার পথ বন্ধ।রাশিয়ার আসরে গ্রুপ পর্বে পেরুর বিপক্ষে গোল করে শুরু হয় এমবাপের পথ চলা। পরে নকআউট পর্বের মহারণে করেন তিন গোল। শেষ ষোলোয় দুইবারের চ্যাম্পিয়ন আর্জেন্টিনার জালে বল পাঠান দুইবার। প্রথম শিরোপার স্বপ্নে বিভোর হয়ে থাকা ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে মস্কোর ফাইনালেও পান জালের দেখা। ফ্রান্সের ৪-২ ব্যবধানের জয়ে শেষ গোলটি করেন ফ্রান্সের ‘কুখ্যাত’ শহরতলি বঁদি থেকে উঠে আসা এই ফরোয়ার্ড।প্যারিসের উত্তর-পূর্বে ১০ কিলোমিটার দূরের পিছিয়ে থাকা জনপদ বঁদি একসময় পরিচিত ছিল দাঙ্গা আর কলহের কারণে। ২০০৫ সালের দাঙ্গায় ক্ষতবিক্ষত হয়েছিল এমবাপের বেড়ে ওঠার আঙিনাাও। তখন তার বয়স মাত্র সাত বছর। এই জনপদটি বদলে যায় এমবাপের জাদুতে। ২০১৮ বিশ্বকাপের পর ঘরের ছেলেকে উৎসব-উচ্ছ্বাসে বরণ করে নেয় তারা। দেয়ালে সাঁটানো হয় এমবাপের ঢাউস ছবিতে, তাতে লেখা থাকে বদলে যাওয়ার বার্তা ‘সিটি অব পসিবিলিটিস’, অর্থাৎ ‘সম্ভাবনার শহর।’বঁদির দুষিত বাতাস থেকে ছেলেকে আগলে রেখেছিলেন বাবা-মা। এমবাপের মা ছিলেন সফল হ্যান্ডবল খেলোয়াড়। বাবা উইলফ্রেড ছিলেন ফুটবল কোচ, ফুটবলার হিসেবে নিজে যে উচ্চতায় পৌঁছাতে পারেননি, ছেলেকে দিয়ে সে চূড়া ছুঁতে চেয়েছিলেন তিনি। ছেলেরও ছিল ফুটবল প্রতি প্রেম। এতটাই যে, উইলফ্রেড ছেলের শৈশবের স্মৃতিচারণ করতে বলেছিলেন, “ফুটবল খেলতে তো বটেই, টানা চার-পাঁচটি ম্যাচও সমান মনোযোগ নিয়ে দেখত এমবাপে।” এখন তার ছেলের ম্যাচ দেখে সবাই!
কাতারে এসেও দেখিয়ে চলেছে এমবাপে, জাত চেনাচ্ছেন প্রতি ম্যাচে। গতি, স্কিল, ড্রিবলিং এবং কার্যকারিতার মিশেলে নিজেকে মেলে ধরছেন। সবশেষ পোল্যান্ড ম্যাচে অলিভিয়ে জিরুদকে দিয়ে গোল করানোর পর নিজেও উপহার দিয়েছেন দারুণ দুটি গোল। ৭৪তম মিনিটে ডান দিক থেকে উসমান দেম্বেলের পাস ধরে বক্সের একটু ভেতরে ঢুকে জায়গা বানিয়ে ডান পায়ের নেওয়া শট ওপরের কোণা দিয়ে জাল খুঁজে নেন।যোগ করা সময়ের প্রথম মিনিটে ব্যবধান আরও বাড়ান তিনি। মার্কাস থুরামের পাস বক্সের ভেতর কোনাকুনি জায়গায় পান । দুই খেলোয়াড়ের মাঝ দিয়ে ডান পায়ের শটে দূরের পোস্ট দিয়ে লক্ষ্যভেদ করেন।এই ম্যাচে দুটি রেকর্ড নিজের করে নিলেন এমবাপ। বিশ্বকাপে নিয়ে তার গোল হলো ৯টি। বয়স ২৪ বছর হওয়ার আগে বিশ্ব সেরার মঞ্চে সবচেয়ে বেশি গোলের রেকর্ডের পাতায় কিংবদিন্ত পেলেকে (৭টি) ছাড়িয়ে এককভাবে চূড়ায় বসলেন তিনি। ভেঙে দিলেন পর্তুগিজ গ্রেট ইউজেবিওর সবচেয়ে কম বয়সে বিশ্বকাপের আট গোলের রেকর্ডও। ২৪ বছর ১৮২ দিন বয়সে ৮ গোল করেছিলেন ইউজেবিও। এমবাপে রেকর্ডটি নিজের করে নিলেন মাত্র ২৩ বছর ৩৪৯ দিন বয়সে।বঁদির সেই ছোট্ট এমবাপে আগামী ১৮ ডিসেম্বর ফাইনালের দুই দিন পর ২৪ বছর পূর্ণ করবে। ছেলেবেলায় ফুটবল খেলা ছাড়া যার শখ ছিল গান গাওয়া, বাঁশি বাজানো। গান ও বাঁশি শেখার স্কুলে পড়তেও গিয়েছিলে তিনি। কিন্তু উইভেস মঁতাঁদ কিংবা জ্যাঁ-জাকুইস গোমাঁ মতো গায়ক হয়ে ওঠা হয়নি তার। ফুটবলারই হতে চেয়েছিলেন তিনি।বল পায়ে এমবাপেও তো মঁতাঁদ বা গোমাঁ! তার গোলে জড়িয়ে মঁতাঁদের মর্মস্পর্শী গানের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া বাঁশির সুর, মাঠজুড়ো গতিময় ছুটে চলার পরতে পরতে যে বাজে গোঁমার পপ মিউজিকের ঝংকার। বল পায়ে গোলের ফুল ফুটিয়ে মরুভূমির বিশ্বকাপ এরই মধ্যে মাতিয়ে ফেলেছেন এমবাপে। আগামী ১৮ ডিসেম্বরের ফাইনাল পর্যন্ত ফ্রান্স ছুটলে, এই তরুণ বয়সেই তিনি কত উঁচুতে পৌঁছুবেন, কে জানে!