Tuesday, May 20, 2025
বাড়িবিশ্ব সংবাদগাজা থেকে ফিরে ট্রমার সঙ্গে যুদ্ধ, আত্মাহুতি দিচ্ছেন ইসরায়েলি সেনারা

গাজা থেকে ফিরে ট্রমার সঙ্গে যুদ্ধ, আত্মাহুতি দিচ্ছেন ইসরায়েলি সেনারা

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ২৬ অক্টোবর: এক বছর আগে ইসরায়েলে হামাসের প্রাণঘাতী হামলার পর ৪০ বছর বয়সী এলিরান মিজরাহিকে পাঠানো হয়েছিল গাজায়, হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে। ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর এই রিজার্ভ সদস্য দেশে ফেরেন এক ‘ভিন্ন মানুষ’ হয়ে।তার পরিবার বলছে, গাজায় যুদ্ধে গিয়ে মিজরাহি যা দেখেছেন, তাতে তিনি মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন।

যুদ্ধে যাওয়ার ছয় মাস পর বাড়ি ফিরে তিনি পোস্ট-ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিসঅর্ডারে (পিটিএসডি) ভুগছিলেন। ফের যুদ্ধে পাঠানোর আগে তিনি আত্মাহুতির পথ বেছে নেন।তার মা জেনি মিজরাহি বলছিলেন, “সে গাজা ছেড়ে ফিরে এসেছিল, কিন্তু গাজা তাকে ছাড়েনি। পোস্ট-ট্রমার কারণে তার মৃত্যু হল।”গাজা যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে এলিরান মিজরাহির মত মনোপীড়ায় আক্রান্ত ইসরায়েলি সৈন্যদের গল্প এক প্রতিবেদনে তুলে এনেছে সিএনএন।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী বলছে, যুদ্ধের সময় মানসিক আঘাতে পিটিএসডি বা মানসিক অসুস্থতায় ভোগা হাজার হাজার সেনা সদস্যকে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে।তবে তাদের মধ্যে কতজন যুদ্ধের দহন থেকে মুক্তি পেতে এলিরান মিজরাহির মত আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন, সেই সংখ্যা ইসরায়েল প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করেনি।গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, গেল একবছরে ইসরায়েলের হামলায় ৪২ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনির প্রাণ গেছে। তাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের যে হামলার পর ওই যুদ্ধের সূত্রপাত, সেই হামলায় ইসরায়েলের ১২০০ মানুষের প্রাণ যায়, জিম্মি করা হয় ২৫০ জনকে। ইহুদি রাষ্ট্রটি গঠনের পর থেকে আর কখনো নিজেদের পক্ষে এত প্রাণক্ষয় দেখতে হয়নি।গাজার যুদ্ধ এখন লেবাননেও ছড়িয়েছে। ইসরায়েলের অনেক সেনা সদস্য এখন ভয়ে আছেন, তাদের হয়ত আরেক যুদ্ধে ডাক পড়বে।গাজায় চার মাস দায়িত্ব পালন করা আইডিএফের এক চিকিৎসক নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিএনএনকে বলেন, “আমাদের মধ্যে অনেকেই ভয়ে আছেন। তারা ভাবছেন, হয়ত তাদের লেবাননে যুদ্ধ করতে পাঠানো হবে। এই মুহূর্তে আমরা অনেকেই সরকারের ওপর আস্থা রাখতে পারছি না।”

কেবল আইডিএফের তত্ত্বাবধানে বিরল দু-একটি সফর ছাড়া বিদেশি সাংবাদিকদের গাজায় ঢুকতে দেয় না ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষ। সে কারণে ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার পূর্ণাঙ্গ চিত্র বা সেখানে ইসরায়েলি সেনাদের অভিজ্ঞতা জানা বেশ কঠিন।গাজায় যুদ্ধ করা ইসরায়েলি সেনারা সিএনএনকে বলেছেন, তারা এমন ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করেছেন, যা বাইরের বিশ্ব কখনো অনুধাবন করতে পারবে না।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর ‘চিরকালীন যুদ্ধের’ ভয়ঙ্কর নির্মমতা আর তার জেরে ইসরায়েলি সৈন্যদের যে অদৃশ্য মাশুল গুনতে হচ্ছে, তা উঠে এসেছে তাদের কথায়।অনেক সৈন্যের কাছে গাজার যুদ্ধ ইসরায়েলের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই এবং যে কোনো উপায়ে সেটা জিততে হবে। কিন্তু এ লড়াইয়ে যে মানসিক মাশুলও গুনতে হচ্ছে, তা অনেকটাই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যাচ্ছে।এই যুদ্ধ যে ইসরায়েলি সমাজের ওপর মনস্তাত্ত্বিক চাপ বাড়িয়ে দিচ্ছে, তা কয়েকজন ইসরায়েলি সেনা, একজন চিকিৎসক এবং আত্মাহুতি দেওয়া রিজার্ভ সেনা মিজরাহির পরিবারের কথায় উঠে এসেছে।

মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষতি

মিজরাহিকে গাজায় ডি-নাইন বুলডোজার চালানোর কাজে নিয়োজিত করা হয় েগল বছরের ৮ অক্টোবর। ৬২ টনের ওই সাঁজোয়া যান বুলেট ও বিস্ফোরক প্রতিরোধী।তার মা জেনি বলছিলেন, মিজরাহির জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে বেসামরিক কাজে; একটি নির্মাণ কোম্পানিতে তিনি কাজ করতেন ব্যবস্থাপক হিসেবে। ৭ অক্টোবর হামাসের ‘নৃশংসতা; প্রত্যক্ষ করার তিনি যুদ্ধে যাওয়ার তাগিদ অনুভব করেন।

পরিবার জানিয়েছে, এ রিজার্ভ সৈন্য হাঁটুতে আঘাত পাওয়ার আগ পর্যন্ত গাজায় ১৮৬ দিন কাটান। গত ফেব্রুয়ারিতে তার গাড়িতে রকেট-চালিত গ্রেনেড (আরপিজি) আঘাত হানার পর শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু চিকিৎসায় কোনো লাভ হয়নি।অধিকৃত পশ্চিম তীরের ইসরায়েলি মালে আদুমিম বসতির বাসিন্দা জেনি বলেন, “তারা জানত না তাদের (সৈন্যদের) সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হয়।“তারা (সৈন্যরা) বলেছে, এ যুদ্ধ একেবারেই আলাদা ছিল। তারা এমন সব জিনিস দেখেছে যা ইসরায়েলে কখনো তারা দেখেনি।”

পরিবার জানিয়েছে, মিজরাহি যখন ছুটিতে ছিলেন- তখন তার মধ্যে মানসিক চাপের বিভিন্ন উপসর্গ শুরু হয়। হঠাৎ তিনি ক্ষুব্ধ হয়ে উঠতেন, অস্বাভাবিক ঘাম হত, ঘুম হত না ঠিকমত; নিজেকে তিনি সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলছিলেন।মিজরাহি তার পরিবারকে বলেছিলেন, তার সঙ্গে গাজায় যারা ছিলেন, কেবল তারাই বুঝবে যে তিনি কীসের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন।তার বোন শির সিএনএনকে বলেন, “সে সব সময় বলত, ‘আমি যা দেখেছি তা কেউ বুঝতে পারবে না’।”

ছেলে কাউকে মেরে ফেলতে পারে- এমন দুশ্চিন্তায় থাকতেন জেনি।“সে অনেক মানুষকে মরতে দেখেছে। সে কাউকে খুন করেও ফেলতে পারে। (কিন্তু) আমরা আমাদের সন্তানদের এ ধরনের কাজ করতে শেখাইনি। সে যখন এমনটা করেছে, তখন সেটা ওর জন্য বড় ধাক্কা ছিল।”গাজার অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে মিজরাহির বন্ধু ও বুলডোজারের সহ-চালক গাই জাকেনের উপলব্ধি ফুটে উঠেছে।তিনি বলেন, “আমরা খুব, খুব, খুব কঠিন জিনিস দেখেছি। ওই বিষয়গুলো মেনে নেওয়া কঠিন।”

গাজায় ইসরায়েলি সেনাদের মানসিক আঘাত পাওয়ার কথা প্রকাশ্যে বলেন সাবেক এই সেনা সদস্য। গত জুনে ইসরায়েলের পার্লামেন্ট নেসেটে দেওয়া এক সাক্ষ্যে জাকেন বলেন, অনেক সময় সৈন্যদের ‘শত শত জীবিত বা মৃত সন্ত্রাসীর’ ওপর দিয়ে যেতে হয়।তিনি বলেন, “তাদের সবার ফিনকি দিয়ে রক্ত ছুটছিল।”জাকেন এখন আর মাংস খেতে পারেন না, কারণ সেটা তাকে গাজায় বুলডোজার থেকে দেখা বীভৎস দৃশ্যের কথা মনে করিয়ে দেয়। রাতে তার ঘুমাতে কষ্ট হয়, কারণ মাথার ভেতর বিস্ফোরণের শব্দ বাজে।

মৃতদেহকে ‘মাংস’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, “যখন আপনি বাইরে প্রচুর মাংস ও রক্ত দেখবেন… আমাদের এবং তাদের (হামাস), তারপরে আপনি যখন (মাংস) খেতে বসবেন, ওই স্মৃতি সত্যি আপনাকে পীড়া দেবে।”জাকেন বলেন, তিনি যাদের মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের বেশিরভাগকে তিনি ‘সন্ত্রাসী’ হিসেবেই দেখেন।“আমরা যখন কোনো বেসামরিক লোককে দেখেছি, আমরা তাদের থামিয়েছি, তাদের খাবার পানি দিয়েছি। আমাদের খাবার থেকে তাদের খেতে দিয়েছি।”

ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক চিকিৎসকের ভাষ্য, সৈন্যরা যখন বেসামরিক নাগরিকদের মুখোমুখি হয়, তখন অনেকে নৈতিকতার করণে ধন্দে পড়ে যায়।তিনি বলেন, যুদ্ধের শুরুতে গাজার ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলি সেনাদের মনোভাব বিরূপ ছিল। তাদের মধ্যে সাধারণ ধারণা ছিল, বেসামরিক নাগরিকসহ গাজাবাসীরা সবাই ‘খারাপ’, কারণ তারা হামাসকে সমর্থন করে, হামাসকে সহায়তা করে, তাদের গোলাবারুদ লুকিয়ে রাখে।তবে নিজের চোখে গাজার বেসামরিক নাগরিকদের দেখার পর সেই মনোভাব বদলে যাওয়ার কথা বলেছেন অনেক সেনা সদস্য।

আইডিএফ দাবি করেছে, গাজায় যাতে বেসামরিক নাগরিক হতাহতের সংখ্যা সর্বনিম্নে থাকে, সেজন্য ‘যথাসাধ্য’ চেষ্টা করে তারা। সেজন্য তারা টেক্সট বার্তা পাঠায়, ফোন কল করে এবং হামলার আগে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যেতে লিফলেট ফেলে।এরপরও গাজায় বিপুল সংখ্যক বেসামরিক নাগরিক মারা গেছেন; এমনকি সামরিক বাহিনী স্বীকৃত ‘নিরাপদ অঞ্চলে’ আশ্রয় নেওয়ার পরও।সিএনএন লিখেছে, ত্রাণকর্মীরা ও জাতিসংঘ বারবারই বেসামরিক নাগরিকদের ওপর যুদ্ধের বিপর্যয়কর প্রভাবের কথা তুলে ধরেছে। ১৭ বছরের অবরুদ্ধ দশা এবং ইসরায়েলের সঙ্গে বেশ কয়েকটি যুদ্ধের কারণে তাদের মধ্যে অনেকেই মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন।

জাতিসংঘ অগাস্টের এক প্রতিবেদনে বলেছে, যুদ্ধের ভয়াবহতা গাজাবাসীর মনে যে ক্ষত তৈরি করেছে, তা পিটিএসডি’র প্রচলিত সংজ্ঞায় ফেলা যায় না।মিজরাহি আত্মহত্যা করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কিছু ভিডিও ও ছবি ছড়িয়ে পড়ে; যেখানে দেখা যায়, বুলডোজার দিয়ে তিনি গাজার বাড়িঘর ও ভবন গুঁড়িয়ে দিচ্ছেন এবং ভাঙা স্থাপনার সামনে দাঁড়িয়ে ছবির জন্য পোজ দিচ্ছেন। তার সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্টে পোস্ট করা কিছু ছবি ইসরায়েলের চ্যানেল ১৩-এ প্রচারিত একটি প্রমাণ্যচিত্রে দেখা গেছে। সেসব অ্যাকাউন্ট এখন সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

তার বোন শির বলেন, তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এমন অনেক মন্তব্য দেখেছেন, যেখানে মিজরাহিকে ‘খুনি’ হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছে। তাকে অভিশাপ দেওয়ার পাশাপাশি অপ্রীতিকর ইমোজি দিয়েছেন অনেকে।শির বলেন, এ পরিস্থিতি কঠিন ছিল, যেটাকে এড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিলেন মিজরাহি।

মৃতদেহ আড়াল ধ্বংসস্তূপ দিয়ে

১৯৮২ সালের লেবানন যুদ্ধসহ ছয় বছর ইসরায়েলি সেনাবাহিনীতে দায়িত্ব পালন করা আহরণ ব্রেগম্যান এখন লন্ডনের কিংস কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানী।তার ভাষ্যে, গাজা যুদ্ধ ইসরায়েলের অন্য যে কোনো যুদ্ধ থেকে আলাদা।“এটা অনেক দীর্ঘ। যুদ্ধটা হয়েছে শহরে, তার মানে সৈন্যরা অনেক মানুষের মধ্যে লড়াই করেছে; তাদের বেশির ভাগই বেসামরিক নাগরিক।”

ব্রেগম্যান বলেন, যুদ্ধে সরাসরি নৃশংসতার সঙ্গে যারা সবচেয়ে বেশি জড়িত, তাদের মধ্যে বুলডোজার অপারেটররা রয়েছেন।“তারা সামনে দেখতে পায় মৃত মানুষ। ধ্বংসাবশেষের সঙ্গে তারা সেসব লাশ পরিষ্কার করে। তারা সেই সব লাশের ওপর দিয়ে যায়।”

ব্রেগম্যান বলেন, অনেকের জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে বেসামরিক জীবনে ফিরে আসা কঠিন ঠেকতে পারে, বিশেষ করে শহুরে যুদ্ধের পরে, যেখানে নারী ও শিশুদের মৃত্যু জড়িত।“গাজায় শিশুদের মরতে দেখার পর আপনি কীভাবে আপনার বাচ্চাদের বিছানায় নিয়ে ঘুমাবেন?”

মিজরাহির পরিবার বলছে, পিটিএসডি আক্রান্ত হলেও যখন আবার মিজরাহিকে যুদ্ধে ডাকা হয়, তখন তিনি গাজায় ফিরতে রাজি হয়েছিলেন। পুনরায় মোতায়েনের দুদিন আগে তিনি আত্মহত্যা করেন।মা জেনি প্রয়াত ছেলের স্মরণে বাড়িতে একটি ঘর উৎসর্গ করেছেন, যেখানে মিজরাহির শৈশব এবং নির্মাণ খাতে কাজ করার সময়ের ছবি স্থান পেয়েছে। মা সেখানে সেই টুপিটিও রেখেছেন, যেটি পরে নিজের মাথায় গুলি করে আত্মহত্যা করেছিলেন মিজরাহি; ওই টুপিতে বুলেটের গর্ত স্পষ্টই দৃশ্যমান।

আইডিএফ মিজরাহিকে সামরিক আনুষ্ঠানিকতায় কবর দিতে অস্বীকার করলে তার মৃত্যুর বিষয়ে কথা বলতে শুরু করে পরিবার। আইডিএফ এর ভাষ্য ছিল, মৃত্যুর সময় মিজরাহি দায়িত্বে সক্রিয় ছিলেন না। অবশ্য পরে তারা সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে।সামরিক তথ্যের ভিত্তিতে ইসরায়েলি সংবাদপত্র হারেৎজ জানিয়েছে, গত বছরের ৭ অক্টোবর থেকে এ বছরের ১১ মের মধ্যে আত্মহত্যা করেছেন অন্তত ১০ জন সৈন্য।যুদ্ধের পর আইডিএফে আত্মহত্যার সংখ্যা কত- এ প্রশ্নের উত্তরে মনোবিজ্ঞানী ও আইডিএফের কমব্যাট রেসপন্স ইউনিটের কমান্ডার উজি বেচোর সিএনএনকে বলেন, পরিসংখ্যান সরবরাহের অনুমতি মেডিকেল কর্পসকে দেওয়া হয়নি এবং সামরিক বাহিনী আত্মহত্যার হারে তেমন হেরফের দেখছে না।

গত ১০ বছরে সেনাবাহিনীতে আত্মহত্যার হার কমেছে দাবি করে বেচোর বলেন, “গত পাঁচ-ছয় বছরে সেনাবাহিনীতে আত্মহত্যার হার কমবেশি স্থিতিশীল রয়েছে।”আত্মহত্যার সংখ্যা বেশি হলেও ‘আনুপাতিক হারে’ তা আগের বছরের মতই আছে দাবি করে তিনি বলেন, “এখন আমাদের সৈন্য বেড়েছে। তার মানে আবার এই নয় যে আত্মহত্যার প্রবণতাও বেড়েছে।”বেচোর আত্মহত্যার সংখ্যা বা হার সিএনএনকে তথ্য দেননি। তিনি বলেন, “প্রত্যেকটি ঘটনাই আমাদের জন্য হৃদয়বিদারক।”

যুদ্ধ থেকে সরিয়ে আনা সেনাদের এক-তৃতীয়াংশের বেশি মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যায় ভুগছেন। ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের পুনর্বাসন বিভাগ গেল অগাস্টে এক বিবৃতিতে জানায়, প্রতি মাসেই এক হাজারের বেশি আহত সৈন্যকে চিকিৎসার জন্য যুদ্ধক্ষেত্র থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়, তাদের মধ্যে ৩৫ শতাংশ মানসিক সমস্যার কথা বলেছেন। ২৭ শতাংশের মধ্যে মানসিক ট্রমা-পরবর্তী স্ট্রেস ডিসঅর্ডার দেখা দেয়।

বিবৃতিতে এও বলা হয়, বছর শেষ নাগাদ চিকিৎসার জন্য ভর্তি আহত যোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়াবে ১৪ হাজারে, যাদের প্রায় ৪০ শতাংশ মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে ধারণা করা হচ্ছে।ইসরায়েলের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, সেখানে প্রতি বছর ৫০০ জনের বেশি মানুষ আত্মহত্যা করে এবং ছয় সহস্রাধিক মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করে। তবে এ সংক্রান্ত প্রায় ২৩ শতাংশ ঘটনা সরকারের খাতায় নথিবদ্ধ হয় না।

সামরিক তথ্যের বরাতে টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে, ২০২১ সালে আইডিএফে সৈন্যদের মৃত্যুর প্রধান কারণ ছিল আত্মহত্যা। ওই বছর অন্তত ১১ জন সেনা আত্মহুতির পথ বেছে নিয়েছিলেন।৭ অক্টোবর থেকে আত্মহত্যার হার বৃদ্ধিকে ‘গুজব’ বলে উড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে এ বছরের শুরুতে মন্ত্রণালয় বলেছিল, “মিডিয়া ও সোশাল মিডিয়ায় বিচ্ছিন্ন ঘটনা সামনে আসছে।”কোনো সংখ্যা উল্লেখ না করে মন্ত্রণালয় বলেছিল, সাম্প্রতিক বছরগুলোর একই সময়ের তুলনায় ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে ইসরায়েলে আত্মহত্যার ঘটনা কমেছে।

লেবানন যুদ্ধের অভিজ্ঞতা থাকা প্রবীণ যোদ্ধা ব্রেগম্যান বলেন, ১৯৭০ ও ১৯৮০ এর দশকের তুলনায় এখন পিটিএসডি ও অন্যান্য মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা নিয়ে কথা বলা সহজ। গাজা যুদ্ধ ফেরত সৈন্যরা তাদের অভিজ্ঞতা বাকি জীবন বহন করবে।আইডিএফের এই চিকিৎসক সিএনএনকে বলেন, সেনাবাহিনীর প্রতিটি ইউনিট মোতায়েনের সময় ও পরে একজন করে মানসিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকেন। গাজায় ১৮ বছরের কম বয়সী সৈন্যরা মানসিক আঘাত পাচ্ছে। তারা প্রায়ই কাঁদে বা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ে।

অস্বাভাবিককে স্বাভাবিক করা

আইডিএফের মনোবিজ্ঞানী বেচোর বলেন, মানসিক আঘাত পাওয়া সেনারা যাতে আবার স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারেন, সেজন্য সামরিক বাহিনী যে উপায়ে সহায়তা করে, তার একটি হলো, সেনারা যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে গেছে সেটাকে ‘স্বাভাবিক’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা। সেজন্য ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার ভয়াবহতার কথা তাদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়।কিন্তু মানুষের জন্য এই পরিস্থিতি ‘স্বাভাবিক নয়’ মন্তব্য করে বেচোর বলেন, “যখন সৈন্যরা পিটিএসডি লক্ষণ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ফিরে আসে, তখন তারা জিজ্ঞাসা করে, ‘আমি যা দেখেছি, তারপরে আমি কীভাবে বাড়ি ফিরব? আমি যা দেখেছি, তারপরে আমি কীভাবে আমার বাচ্চাদের সঙ্গে থাকব?’

“আমরা এটাকে স্বাভাবিক হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করি এবং কেন তারা সেখানে (গাজায়) গিয়েছিল তা মনে করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করি।”হাজার হাজার ইসরায়েলি, যাদেরকে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে যুদ্ধ করার জন্য ডাকা হয়েছিল; তাদের সামনে গাজার যুদ্ধকে কেবল আত্মরক্ষা হিসেবে দেখানো হয়নি বরং অস্তিত্বের লড়াই হিসেবে দেখানো হয়েছিল।ইসরায়েলের শীর্ষ রাজনীতিক ও সামরিক নেতাদের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক মিত্ররাও এ প্রচার চালিয়েছে।

হামাসকে ‘নতুন নাৎসি’ বলে বর্ণনা করেছেন নেতানিয়াহু। আর যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেছেন, নাৎসি সমর্থিত ‘ইহুদিদের প্রতি প্রাচীন ঘৃণা’কে ৭ অক্টোবরের হামলার মধ্য দিয়ে ‘পুনরুজ্জীবিত করা হয়েছে।’তাদের দেশের প্রতি বাহ্যিক হুমকি অনেক ইসরায়েলিকে যেমন ঐক্যবদ্ধ করেছে, তেমনি অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কোন্দলকে সাময়িকভাবে ঠেকিয়ে রেখেছে, যে কোন্দলের কারণে কয়েক মাস ধরে ইসরায়েলি সমাজ বিভক্ত হয়ে পড়েছিল।ফিলিস্তিনিদের দুর্দশার কথা ইসরায়েলি টেলিভিশনের পর্দায় একপ্রকার অনুপস্থিত থাকে; তার বদলে গাজায় জিম্মিদের নিয়ে খবরকে গুরুত্ব দেওয়া হয়।

হামাসের হামলার পরে পরিচালিত জরিপে দেখা গেছে, বেশিরভাগ ইসরায়েলি গাজা যুদ্ধকে সমর্থন করেন। অপহৃত জিম্মিদের মুক্তির জন্য যখন আলোচনা চলছিল, তখনও তাদের সরকার লড়াই বন্ধ করতে চায়নি।৭ অক্টোবরের হামলার এক বছর পূর্তিতে ইসরায়েল ডেমোক্রেসি ইনস্টিটিউট প্রকাশিত এক জরিপে দেখা গেছে, মাত্র ৬ শতাংশ ইসরায়েলি মনে করেন ‘মানুষের জীবনের’ কথা ভেবে হলেও গাজার যুদ্ধ বন্ধ করা উচিত।

আর গাজা যুদ্ধে যে ভয়াবহতা দেখতে হয়েছে, তার কোনো যুক্তি খুঁজে পাননি অনেক সেনা সদস্য।মা জেনি বলেন, গাজা থেকে ফেরার পর মিজরাহি প্রায়ই পরিবারকে বলতেন, তার শরীর থেকে ‘অদৃশ্য রক্ত’ বের হচ্ছে।তার মৃত্যুর জন্য যুদ্ধকে দায়ী করে বোন শির বলেন, “সেনাবাহিনীর কারণে, এই যুদ্ধের কারণে আমার ভাই আজ আর এখানে নেই।”মিজরাহির মানসিক যন্ত্রণার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “তিনি (যুদ্ধে) হয়তো রকেট চালিত গ্রেনেড বা বুলেটে মারা যাননি, কিন্তু অদৃশ্য বুলেটে তার মৃত্যু হয়েছে।”

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য

error: <b>Alert: </b>Content selection is disabled!!