Thursday, March 28, 2024
বাড়িবিশ্ব সংবাদতালেবানি শাসনে স্কুল ফের বন্ধ, কান্না চাপতে পারছে না আফগান মেয়েরা

তালেবানি শাসনে স্কুল ফের বন্ধ, কান্না চাপতে পারছে না আফগান মেয়েরা

স্যন্দন ডিজিটাল ডেস্ক। আগরতলা। ২৪ মার্চ। কাবুলের পশ্চিমে এক পাহাড়ের ওপর বাসা ১৫ বছরের মার্জিয়ার। সকাল সকাল উঠে ব্যাগ গুছিয়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য তৈরি হল সে। তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার বুধবারই প্রথম আফগানিস্তানে মেয়েদের জন্য খুলছে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দরজা।

মার্জিয়া বিবিসিকে বলেছিল, যখন সে স্কুল খোলার কথা শুনল, খুবই খুশি হয়েছিল সে।বুধবার সকালে মার্জিয়ার মত প্রায় ২০০ ছাত্রী উপস্থিত হয় সাইয়েদ উল শুহাদা বিদ্যালয়ে, স্বাভিকের চেয়ে যদিও অনেক কম এই সংখ্যা। কারণ পরিবার এখনও নিশ্চিত না, আদৌ মেয়েদের স্কুলে পাঠানো নিরাপদ হবে কিনা।গত অগাস্টে তালেবান ক্ষমতা নেওয়ার পর মেয়েদের স্কুলের মধ্যে কেবল প্রাথমিক বিদ্যালয় খোলার অনুমতি দিয়েছিল; আর খোলা ছিল ছেলেদের সব স্কুল।বুধবার নতুন শিক্ষাবর্ষের শুরুতে অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয়ও খুলে দেওয়ার কথা জানানো হয়েছিল। সেই ঘোষণাতেই স্কুলে গিয়েছিল মার্জিয়ারা।   

গত বছর ইসলামিক স্টেটের সহযোগী এক জঙ্গি সংগঠনের হামলায় এ স্কুলের ৯০ জনের বেশি শিক্ষার্থী ও কর্মীর মৃত্যু হয়। সে কারণে স্কুল খোলার সময়টায় শিক্ষার্থীসহ সবার জন্যই ছিল আবেগময় একটি মুহূর্ত।সেদিনের কথা মনে করে এ স্কুলের ছাত্রী সকিনা জলভরা চোখে বলছিল, “আমার খুব কাছেই প্রথম বিস্ফোরণ হয়। আমার সামনে অনেক মানুষ মরে পড়ে ছিল… আমি ভাবতেও পারিনি যে বেঁচে যাব।”সকিনা ভেবেছিল, ওই হামলা যারা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধের পথ হল পড়ালেখা চালিয়ে যাওয়া। জীবনে সাফল্য অর্জন করতে পারলে শহীদদের স্বপ্ন সে পূরণ করতে পারবে।

শ্রেণিকক্ষে প্রবেশ করে ডেস্ক থেকে ধুলো ঝেড়ে বসতে না বসতেই মার্জিয়া, সকিনারা শুনতে পায়, কয়েকজন শিক্ষক বলাবলি শুরু করেছেন যে স্কুল হয়ত আবারও বন্ধ হয়ে যাবে।এরপর তালেবান শিক্ষা কার্যালয় থেকে প্রধান শিক্ষকের কাছে হোয়াটসঅ্যাপে একটি বার্তা পৌঁছে দেওয়া হয়, যেখানে বলা হয়, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধই থাকবে।ওই খবর শোনামাত্র ছাত্রীদের চোখেমুখে ফুটে ওঠে আতঙ্ক আর অবিশ্বাস। অনেকেই কাঁদতে শুরু করে। ফাতিমা নামের একজন বিবিসিকে বলে, “আমরা শুধু লেখাপড়া শিখতে চাই, আমাদের জনগণকে রক্ষা করতে চাই। এটা কি ধরনের দেশ! আমাদের অপরাধ কী!!”

আবেগে ভেঙে পড়ে তালেবানের উদ্দেশ্যে সে বলে, “আপনারা সবসময় ইসলামের দোহাই দেন, ইসলাম কী এভাবে নারীর অবমাননা করতে বলেছে?”বিবিসি লিখেছে, তালেবানের যুক্তির তল পাওয়া কঠিন। এই পরিস্থিতির মধ্যেই সেখানকার শিক্ষা মন্ত্রণালয় শিক্ষাবর্ষ শুরুর উপলক্ষে অনুষ্ঠান করেছে।মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র আজিজ-উর-রহমান রায়ান বলছেন, বিদ্যালয়গুলো খুলে দেওয়ার সব প্রস্তুতিই শেষ হয়েছে, কিন্তু তালেবানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব “আফগান সংস্কৃতি ও শরিয়া মোতাবেক একটি সমন্বিত পরিকল্পনা প্রণয়ন না করা পর্যন্ত” এসব বিদ্যালয় বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়েছে।

অবশ্য তালেবান ক্ষমতা গ্রহণের আগেও আফগানিস্তানের মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোতে লৈঙ্গিক বিভাজন খুবই স্পষ্ট ছিল, ছাত্রীদের পোশাক হিসেবে বাধ্যতামূলকভাবে কালো রংয়ের জামা ও সাদা হিজাব পড়তে হত।

অবাক করার মত বিষয় হল, কয়েকটি প্রদেশে স্থানীয় তালেবান কর্মকর্তারা গত বছর থেকে মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় চালু করার অনুমতি দিয়েছিলেন, যতিও কেন্দ্রীয় নির্দেশনা তখনও আসেনি।ব্যক্তিগত পর্যায়ে, তালেবানের অনেক নেতাই স্বীকার করেছেন যে, নারী শিক্ষার বিষয়টি তাদের সবচেয়ে কট্টরপন্থিদের কাছে একটি ‘বিতর্কিত বিষয়’।বিবিসি লিখেছে, তালেবানের কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব একদম শেষ মুহূর্তে তাদের নিজেদের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্কুল খোলার সিদ্ধান্ত পাল্টে দিয়েছে, যেহেতু তারা তাদের সবচেয়ে রক্ষণশীল সদস্যদের কথা ফেলতে পারছে না।

তালেবানের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির এই বৈপরিত্য অনেকটা ভৌগলিক। দেশের উত্তর অংশে তুলনামূলক ‘কসমোপলিটন ভাবধারা’ চলে। যখন সেখানে তালেবানের নেতৃত্বে ‘ছায়া সরকার’ পরিচালিত হচ্ছিল, তখনও সেখানকার এক তালেবান নেতা বিবিসিকে গর্বের সঙ্গে একটি মেয়েদের স্কুল দেখিয়ে বলেছিলেন, তাদের অধীনেও মেয়েরা লেখাপড়া শিখছে।অন্যদিকে দক্ষিণাঞ্চলে হেলমান্দের মত রক্ষণশীল প্রদেশের গ্রামাঞ্চলে নারী শিক্ষার বিষয়ে মতামত জানতে চাইলে এক তালেবান যোদ্ধা হেসে বলেছিলেন, “যদি মেয়েরা লেখাপড়া শিখতে চায়, তাদের ভাইয়েরা স্কুলে যেতে পারে এবং তারপর তারা বাড়িতে বোনদের শেখাবে।”

এখন সবচেয়ে রক্ষণশীল অঞ্চলের বেশিরভাগ সাধারণ আফগান পরিবারও নারী শিক্ষার পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। কিন্তু তালেবান কি আদৌ বদলেছে?১৯৯০ এর দশকে তারা যখন প্রথম ক্ষমতা নিয়েছিল, তখন তারা নারীদের আপাদমস্তক বোরখায় ঢেকে চলা বাধ্যতামূলক করেছিল এবং মেয়েদের প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোও বন্ধ রাখা হয়েছিল।এ দফায় ক্ষমতায় ফেরার পর অবশ্য ততটা কঠোর তারা এখনও হয়নি।বিশ্ব ব্যাংকের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, তালেবান আবারো আফগানিস্তানে ক্ষমতা নেওয়ার পর নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে মেয়েদের উপস্থিতি বেড়েছে। তালেবান নারীদের বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়ারও অনুমতি দিয়েছে, যতক্ষণ পর্যন্ত তারা আলাদা শ্রেণিকক্ষে বসে পাঠ নিচ্ছে।তবে মেয়েদের মাধ্যমিক বিদ্যালয় বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত থেকে মনে হয়, বর্তমান আফগান সমাজ এবং তালেবানের নেতৃত্বের মধ্যে এখনও দুস্তর ব্যবধান।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য