Saturday, January 18, 2025
বাড়িবিশ্ব সংবাদবৈশ্বিক ঋণদাতা চীন কেন অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে বেকায়দায়

বৈশ্বিক ঋণদাতা চীন কেন অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়ে বেকায়দায়

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, আগরতলা ,১১ আগস্ট: বিশ্বের উন্নয়নশীল ১৫০টি দেশকে প্রায় এক লাখ কোটি (এক ট্রিলিয়ন) ডলার ঋণ দিয়েছে চীন। অর্থনৈতিকভাবে জর্জরিত এসব দেশ নিজেদের চাহিদা মেটাতে বেশ হিমশিম খাচ্ছে। ঋণ পরিশোধের মতো অবস্থায় নেই বেশির ভাগ দেশ। কিন্তু এসব দেশের বড় অঙ্কের ঋণ মওকুফ করতে রাজি নয় চীন। কেন চীন দুর্দশাগ্রস্ত দরিদ্র দেশগুলোর ঋণ মওকুফে অনাগ্রহী? সেসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে জানা গেল, চীন নিজেই দেশের মধ্যে ‘ঋণ বোমার’ মুখোমুখি।

চীনের স্থানীয় সরকারগুলো, তাদের অধিভুক্ত অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠান ও আবাসন কোম্পানিগুলো সরকারি ব্যাংক থেকে কয়েক লাখ কোটি ডলারের ঋণ নিয়েছে। অবশ্য এসব অধিভুক্ত অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের নাম কাগজে-কলমে কোথাও উল্লেখ নেই।সম্প্রতি চীন সফর করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থমন্ত্রী জ্যানেট ইয়েলেন। এ সফরে আলোচনার অন্যতম বিষয় ছিল, নিম্ন আয়ের দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান ঋণ সংকটের বিষয়টি মোকাবিলায় চীনকে রাজি করানো। কিন্তু চীনের রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত ব্যাংকিং ব্যবস্থা যখন দেশটির অভ্যন্তরে ঋণের ক্ষেত্রে অনেক বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছে, তখন বিদেশি ঋণে ক্ষতি স্বীকারের বিষয়ে তারা সতর্ক রয়েছে।

কত ঋণ আছে চীনের

চীনের ঋণের পরিমাণ ঠিক কত, সেটা জানাটা কঠিন। কারণ, দাপ্তরিক তথ্য-উপাত্ত অনেক কম। জেপি মরগ্যান চেইজের গবেষকদের গত জুনের হিসাব অনুযায়ী, পরিবার, কোম্পানি, সরকারসহ চীনের অভ্যন্তরীণ সামগ্রিক ঋণ দেশটির বার্ষিক অর্থনৈতিক উৎপাদনের ২৮২ শতাংশে গিয়ে ঠেকেছে। বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোতে এই গড় ২৫৬ শতাংশ আর যুক্তরাষ্ট্রে ২৫৭ শতাংশ।অন্যান্য দেশ থেকে চীনকে যেটা আলাদা করে, সেটা হলো এই ঋণ তার অর্থনীতির আকারের তুলনায় কতটা দ্রুত জমেছে। সে তুলনায় যুক্তরাষ্ট্র, এমনকি খুবই ঋণগ্রস্ত জাপানেও কম গতিতে ঋণ বেড়েছে। ১৫ বছর আগে বৈশ্বিক আর্থিক সংকটের পর থেকে চীনের ঋণের ব্যাপক বৃদ্ধি দেশটির অর্থনীতির আকারের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি, যা বিষয়টিকে সামলানো কঠিন করে তুলেছে।

চীন তাদের অভ্যন্তরীণ ঋণের তুলনায় উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তুলনামূলক কম পরিমাণেই ঋণ দিচ্ছে। আর এ ঋণের পরিমাণ হচ্ছে চীনের বার্ষিক অর্থনৈতিক উৎপাদনের ৬ শতাংশের কম। কিন্তু এসব ঋণ বিশেষত রাজনৈতিকভাবে স্পর্শকাতর।কড়া বিধিনিষেধ থাকা সত্ত্বেও চীনের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ক্রমেই অভিযোগের সুরে বলা হচ্ছে, ব্যাংকগুলোর উচিত বিদেশে নয়, দেশের দরিদ্র পরিবার ও অঞ্চলগুলোতে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। তাই বিদেশি ঋণে বড় ক্ষতি স্বীকার করা চীনের মানুষের মধ্যে খুবই অজনপ্রিয় হবে।শুরুটা হয়েছিল আবাসন খাত দিয়ে—অতিরিক্ত নির্মাণ, দাম পড়ে যাওয়া এবং সম্ভাব্য ক্রেতাদের আর্থিক জটিলতায় পড়ে যাওয়া। গত দুই বছরে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ঋণ নেওয়া কয়েক ডজন আবাসন কোম্পানি খেলাপি হয়ে পড়েছে। এসব কোম্পানির মধ্যে সাম্প্রতিক দিনগুলোতে খেলাপি হয়েছে দুটি। আবাসন কোম্পানিগুলো চীনের অভ্যন্তরীণ ব্যাংকগুলোর অনেক বড় অঙ্কের ঋণ পরিশোধে বেশ হিমশিম খাচ্ছে।
চীনের স্থানীয় সরকারগুলো ঋণ করতে থাকায় সমস্যা আরও জটিল আকার ধারণ করে। গত এক দশকে অনেক শহর ও প্রদেশ বিশেষ অর্থায়ন ইউনিট স্থাপন করেছে, যেগুলো হালকাভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠান অনেক বেশি ঋণ করেছে। কর্মকর্তারা অন্য ঋণের সুদ পরিশোধ, সেই সঙ্গে সড়ক, সেতু, পাবলিক পার্ক, অন্যান্য অবকাঠামো নির্মাণসহ প্রাত্যহিক খরচ মেটাতে সেসব ঋণের অর্থ ব্যবহার করেন।আবাসন খাত আর সরকারি ঋণ একে অপরের সঙ্গ যুক্ত। রাষ্ট্রীয় জমি আবাসন কোম্পানিগুলোর কাছে দীর্ঘ সময়ের জন্য ইজারা দিয়ে পাওয়া অর্থই ছিল স্থানীয় সরকারগুলোর রাজস্ব আয়ের প্রধান উৎস। বেসরকারি খাতে অনেক আবাসন কোম্পানি অর্থসংকটে পড়ায় ভূমির নিলামে অংশ নিতে পারছে না। ফলে রাজস্বও কমে গেছে। স্থানীয় সরকারের অধিভুক্ত অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক চড়া দামে এসব ভূমি কিনে নিচ্ছে, যা এ ধরনের আবাসন কোম্পানির সাধ্যের বাইরে। আবাসন খাত অব্যাহতভাবে দুর্বল হতে থাকায় এসব সহযোগী অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানও সমস্যায় পড়েছে।

সেই ঋণের বোঝা ক্রমেই বাড়ছে। ঋণমান সংস্থা ফিচ রেটিংয়ের আনুমানিক হিসাব অনুযায়ী, স্থানীয় সরকারগুলোর কাছে চীনের বার্ষিক অর্থনৈতিক উৎপাদনের প্রায় ৩০ শতাংশের সমান ঋণ রয়েছে। তাদের অধিভুক্ত অর্থায়নকারী ইউনিটগুলো জাতীয় উৎপাদনের আরও ৩০ থেকে ৫০ শতাংশের সমান ঋণ করেছে। অবশ্য ফিচ বলছে, যেহেতু স্থানীয় সরকারগুলো ঋণ নেয় এবং পরবর্তী সময়ে তাদের অধিভুক্ত অর্থায়নকারী ইউনিটগুলোতে সেই ঋণ স্থানান্তর করে থাকে, সে জন্য কিছু ক্ষেত্রে দ্বিগুণ গণনা হতে পারে।

কেন ভাবনার বিষয়

যেকোনো সরকার বা ব্যবসার ক্ষেত্রে ঋণ ভালো অর্থনৈতিক সুফল দিতে পারে, যদি ঋণের অর্থ উৎপাদনশীল খাতে এবং দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা যায়। কিন্তু যেসব ঋণগ্রহীতা মাত্রাতিরিক্ত ঋণ নিয়ে পর্যাপ্ত মুনাফা করতে পারে না, তাদের সমস্যায় পড়তে হয় এবং ঋণদাতাদের অর্থ পরিশোধে হিমশিম খেতে হয়। আর চীনে সেটাই ঘটেছে।চীনের অর্থনীতি মন্থর হওয়ায় স্থানীয় সরকার ও তাদের অর্থায়নকারী ইউনিটগুলোর বড় একটি অংশ ঋণের সুদ পরিশোধ করতে অক্ষম। ফলে আরও যেসব সমস্যার তৈরি হচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে—স্থানীয় সরকারের অনেক পরিষেবা, স্বাস্থ্যসেবা বা পেনশনে ব্যয় করার মতো অর্থের অভাব দেখা দিয়েছে।অভ্যন্তরীণ ঋণ সমস্যা চীনের ব্যাংকগুলোর জন্য নিম্ন আয়ের দেশগুলোতে তাদের ঋণের ক্ষতি মেনে নেওয়াটা কঠিন করে তুলেছে। যদিও এসব দেশের মধ্যে অনেকগুলো, যেমন শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান ও সুরিনাম এখন মারাত্মক অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন।

বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ পণ্য রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। বিশ্বব্যাংক এপ্রিলে পূর্বাভাস দিয়েছে, গত বছরের তুলনায় এ বছর পণ্যের দাম ২১ শতাংশ কম হবে।যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়ার উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি বিশ্ববিদ্যালয়ের এইডডেটার নির্বাহী পরিচালক বলেন, ২০১০ সালে চীনের বিদেশি ঋণের গ্রাহকদের মাত্র ৫ শতাংশ অর্থনৈতিক সংকটে ছিল। বর্তমানে এ সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৬০ শতাংশে।চীন এখন পর্যন্ত উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বৃহত্তম সার্বভৌম ঋণদাতা। যদিও পশ্চিমা হেজ ফান্ডগুলো (একধরনের বিকল্প বিনিয়োগ পদ্ধতি, যার মূল উদ্দেশ্যই হচ্ছে গ্রাহকদের বিনিয়োগের ওপর সর্বোচ্চ মুনাফা দেওয়া) এসব দেশ থেকে অনেক বন্ড কিনেছে। বন্ডগুলো নির্দিষ্ট সুদহারের হয়ে থাকে।

কিন্তু পশ্চিমের সঙ্গে যুক্ত সুদহারের সঙ্গে সামঞ্জস্যযোগ্য সুদহারে ডলারে ঋণ দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে চীনের ব্যাংকগুলোর। যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল রিজার্ভ ২০২২ সালের মার্চ থেকে সুদহার ব্যাপক বাড়িয়ে দেওয়ায় উন্নয়নশীল দেশগুলোকে চীনের ঋণ পরিশোধে অনেক বেশি অর্থ গুনতে হয়েছে।যদি এসব ঋণ কমানোর জন্য তেমন কিছু করা না হয়, তাহলে বিশ্বের অনেক দরিদ্র দেশের সরকারকে ঋণ পরিশোধে বিপুল পরিমাণ অর্থ ব্যয় করতে হবে। অথচ এসব অর্থ বিদ্যালয়, ক্লিনিক ও অন্যান্য পরিষেবার কাজে ব্যবহার করা যেত।পার্কস বলেন, ‘সবচেয়ে বড় ক্ষতির শিকার হবে উন্নয়নশীল বিশ্বের সাধারণ মানুষ, যারা মৌলিক সরকারি সেবা থেকে বঞ্চিত। কারণ, তাদের সরকারগুলো নিজেদের জন্য টেকসই নয়, এমন সব ঋণে জর্জরিত।’

সমাধান কোন পথে

চীনের অভ্যন্তরীণ ঋণ সমস্যার দ্রুত সমাধান নেই। দেশটিকে ধীরে ধীরে ঋণনির্ভর সরকারি নির্মাণ প্রকল্প ও বিপুল জাতীয় নিরাপত্তা ব্যয় থেকে সরে এসে ভোক্তা ব্যয় ও পরিষেবার ওপর ভিত্তি করে একটি স্থিতিশীল অর্থনীতির দিকে যেতে হবে।গত শীত মৌসুমে চীনের ২১টি ব্যাংক দেশটির দক্ষিণ-পশ্চিমের একটি স্থানীয় সরকারের অর্থায়নকারী শাখার কিছু ঋণ পরিশোধের মেয়াদ ২০ বছরের জন্য বাড়াতে সম্মত হয়। এসব ঋণ খেলাপি হওয়ার কাছাকাছি ছিল। ওই সব ব্যাংক বলেছিল, প্রথম ১০ বছরের জন্য মূল নয়, শুধু সুদ পরিশোধ করতে হবে। কিন্তু এ ব্যবস্থা ব্যাংকগুলোর জন্য অনেক লোকসানি। এ ব্যবস্থা চীনের প্রায় প্রতিটি প্রদেশের স্থানীয় অর্থায়নকারী শাখাগুলোকে একইভাবে জটিলতার মধ্যে ফেলে দিয়েছে।তবে উন্নয়নশীল দেশগুলোর ঋণ সমস্যার সমাধান আরও বেশি কঠিন হবে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ মন্ত্রণালয়ে দীর্ঘদিন কাজ করেছেন মার্ক সোবেল। এসব ঋণ ও মার্কিন অর্থমন্ত্রী ইয়েলেনের চীন সফরের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র ও ইয়েলেনের তেমন কিছু করার সুযোগ নেই।’

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য