Friday, December 6, 2024
বাড়িখেলারোনালদিনিওরা ‘অস্ত্র’ জমা দেন, ট্রেনিং নয়

রোনালদিনিওরা ‘অস্ত্র’ জমা দেন, ট্রেনিং নয়

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ২৯ নভেম্বর:  বল জাল ছোঁয়ার পর ধারাভাষ্যকার কণ্ঠে আবেগ ঢেলে বললেন, ‘স্টেডিয়ামের কেউ বিস্মিত হয়নি।’ শুধু করতালির শব্দ।প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড়দের মুখেও হাসি। সেটি কি শুধুই প্রীতি ম্যাচের জন্য? দলটার নাম যে রিয়াল মাদ্রিদ! বার্সেলোনার কেউ তাঁদের জালে বল পাঠাবেন, আর সেটা তাঁরা হেসেখেলে উদ্‌যাপন করবেন—এ জিনিস কল্পকাহিনিতে সম্ভব, বাস্তবে কে কবে দেখেছে!

কাতারে গতকাল রাতে প্রীতি ম্যাচটি দেখে থাকলে আপনিও বলবেন, এ শুধু কিংবদন্তিদের দ্বারাই সম্ভব, যাঁরা অতীত ও বর্তমানকে গাঁথতে পারেন একসূত্রে। ফেলে আসা সোনালি সময়কে ফিরিয়ে আনতে পারেন পায়ের সামান্য এক স্পর্শে। মঞ্চে জাদুকরের হাতে থাকে জাদুকাঠি। ফুটবলারদের জন্য ব্যাপারটা আলাদা। মন্ত্রপূত কাঠি নিয়ে মাঠে নামার সে সুবিধাটা তাঁদের নেই। বরং তাঁদের কারও কারও ক্ষেত্রে সুবিধা আরও বেশি। সেটা প্রথমে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত, পরে ঘষেমেজে বানিয়ে নিতে হয়, তখন শরীরের কোনো একটি অঙ্গপ্রত্যঙ্গই হয়ে ওঠে জাদুকাঠি। যেমন রোনালদিনিওর ডান পা!

ফ্যান্টাসি গল্পে আপনি এমন পাবেন। পাঁচ শ কিংবা হাজার বছর পর হয়তো পুনরুজ্জীবিত হয়েছেন কোনো জাদুকর। বয়স হয়তো বেড়েছে, এত দিন বেকার বসে থাকতে থাকতে শরীরও হয়তো বেশ ভারী হয়েছে, কিন্তু ধার কমেনি। মঞ্চে সেই একই ঢঙে দাঁড়িয়ে একই অ্যাব্র্যা কা ড্যাবরার জাদুবাস্তবতায় ডুবিয়ে ছাড়েন চারপাশ। খলিফা স্টেডিয়ামে ম্যাচের ১৬ মিনিটে রোনালদিনিও ঠিক সেভাবেই দাঁড়িয়েছিলেন। যেভাবে আপনি তাঁকে দেখতে অভ্যস্ত ছিলেন নিজের শৈশবে, কৈশোরে, তারুণ্যে কিংবা মাঝ বয়সে।

বক্সের মাঝে যে ‘ডি’-তার বাঁ দিকে বলটি বসানো। পোস্ট থেকে ২০ গজের দূরত্ব। জাদুকর আড়াআড়ি কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে। একবার বল দেখছেন, আরেকবার পোস্ট। আসলে চোখের অদৃশ্য কাঁটা-কম্পাসে মেপে নিচ্ছিলেন, যেন পায়ের শটের হিসাবে গড়বড় না হয়। সেই একইভাবে, বাঁ দিকে ঘাড় কাত করে-রোনালদিনিওকে যদি চেনা থাকে, যদি ডেভিড বেকহামকেও জানা থাকে, তাহলে আপনি এ-ও জানেন, তাঁদের জাতের ফ্রি–কিক টেকাররা সব সময়ই বলকে বাঁক খাওয়ান নিজেদের বাঁ দিকে। অর্থাৎ ক্রিকেটে ডানহাতি ব্যাটসম্যানের ক্ষেত্রে যেটা আউট সুইং। জাদুকরের চোখ দুটো তখন বলের সেই সুইংয়ের গতিপথই আবিষ্কারের চেষ্টায় ব্যস্ত। আর মাঠের অন্য সবাই থেকে গ্যালারির সব চোখ তাঁর প্রতি ন্যস্ত। যেন সবাই জানতেন, কিছু একটা হতে যাচ্ছে!

হলো আসলে ৬৬ বছর বয়সী ফ্রান্সিসকো বোয়োরের। রিয়ালের হয়ে ৬ বার লিগজয়ী ও ১৯৯৪ সালের ৩ ডিসেম্বর পরের বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত লা লিগায় ৭০৯ মিনিট গোল হজম না করার গৌরবপুষ্ট সাবেক এই স্প্যানিশ গোলকিপার কোনো ভুলই করেননি। কাঁচা–পাকা চুলের বয়সের ভার নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন তাঁর বাঁ দিকের পোস্ট ঘেঁষে। কারণ, ডানে ছিল মানবদেয়াল।

মঞ্চে জাদুকরের যেমন সংগত বা সহকারী থাকে, তেমনই সেই ‘দেয়াল’–এর মাঝের ফাঁকে দাঁড়িয়েছিলেন হুয়ান পাবলো সোরিন। ততক্ষণে আপনার বুঝে ফেলার কথা, কী কী ঘটতে পারে! জাদুকর তাঁর সময়ে মানবদেয়ালের নিচ দিয়েও গোল করেছেন, আবার সেই দেয়ালের মাঝে এক সতীর্থকে দাঁড়িয়ে করিয়ে তাঁকে বন্দুকের কল্পিত ফ্রন্ট পয়েন্ট বানিয়ে সেদিক দিয়ে শট করেও গোল করেছেন। রোনালদিনিও করলেন পরেরটাই, তবে তাতে থাকল নিজের সিগনেচারও।

শট নেওয়ার কয়েক সেকেন্ড আগে মানবদেয়াল থেকে সরে দাঁড়িয়েছিলেন সহকারী সোরিন, যেন ওই ফাঁকা জায়গা দিয়ে বলটা পাঠাতে পারেন তাঁর ‘ওস্তাদ’। কিন্তু লোকটা ব্রাজিলিয়ান বলেই সম্ভবত নিজের আসল কাজে কোনো আর্জেন্টাইনের সাহায্য নিতে চাননি! তাই সেই ফাঁকা জায়গা দিয়ে বলে নিচু শট নেননি। বলটা তুললেন, বাঁকও নিল যথেষ্ট, ঠিক যেভাবে পোর্তো আলেগ্রেতে দারিদ্র্যক্লিষ্ট শৈশবকে বাঁক খাইয়ে কিংবদন্তি হয়ে থেমেছে তাঁর ক্যারিয়ার—আর সেই বাঁকের জাদুতে বিবশ হলেন বোয়োর। ধারাভাষ্যকারের কথায়, বল জালে জড়ানো পর্যন্ত বোয়োর একচুলও নড়তে পারেননি!

রিয়াল কিংবদন্তি ক্ল্যারেন্স সিডর্ফের মুখে হাসি। বুকে হাত দিয়ে কী বলছিলেন কে জানে! হয়তো সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছিলেন, পুরোনো সেই সময়কে রোনালদিনিওর মাধ্যমে মাত্র ৯০ মিনিটের জন্য হলেও ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। লুইস ফিগো তাঁর স্বভাবসুলভ রিয়াল ‘ইগো’ ধরে রেখে রেফারির সঙ্গে এক চোট সেরেও নিলেন। তারপর স্মিত হাসলেন। ওদিকে জাদুকর ক্যামেরার সামনে। দুই কাঁধ এমনভাবে শ্রাগ করলেন যেন বয়স যা–ই হোক, এটাই তো তাঁর কাজ! কিন্তু জাদুকর যেটা জানতে পারেননি, চিরায়ত সেই শিশুসুলভ হাসিটা ধরে রেখে গুটি গুটি পায়ে তিনি যখন ক্যামেরার সামনে এগিয়ে আসছিলেন, তখন স্ক্রিনে তাঁকে দেখে অন্যদের কেমন লেগেছে।

সেই ভীষণ উজ্জ্বল চোখ, সেই শিশুসুলভ নিষ্পাপ হাসি, যা দেখে আপনি ফুটবলকে ভালোবাসতে বাধ্য, মুখটা একটু পাল্টেছে ভরাট হওয়ায় আর থুতনির নিচে দাঁড়িগুলোতে সাদা রং ধরেছে। আপনি ব্রাজিল কিংবা বার্সেলোনার সমর্থক হন বা না-ই হন, বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, ঠিক সে সময় আপনাকে কয়েক বছর পেছনে ফিরিয়ে নেয়নি? সেই যে রাত জেগে খেলা দেখার শৈশব, কৈশোর কিংবা তারুণ্যের দিনগুলো, সেসব নস্টালজিয়ায় ফিরিয়ে নেওয়াই হয়তো সত্যিকারের জাদুকরদের আসল জাদু। ‘গার্ডিয়ান’–এর বিখ্যাত স্প্যানিশ ফুটবল লিখিয়ে সিড লো–এর ভাষায়, ‘রোনালদিনিও যা করেছে, সেটা আর কেউ পারেনি। সেটা শুধু সে যা করেছে সে জন্য নয়, যেভাবে সে করেছে (পড়ুন খেলেছে), লোকে তাতে যা অনুভব করেছে—নস্টালজিয়া, স্মৃতি, আবেগ।’

কিংবা তাঁর সেরা সময় যাঁরা দেখেননি, তাঁদেরও ভাবতে বাধ্য করা চুয়াল্লিশেই যদি এমন হয়, তাহলে বিশ-পঁচিশে কেমন ছিলেন! শুনতে পারেন তাঁরই একসময়ের বার্সা সতীর্থ ডেকোর মুখে, ‘মেসি ও ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর চেয়েও প্রতিভাবান ছিল রোনালদিনিও।’শুনতে পারেন মেসির মুখেও, ‘রোনালদিনিও বার্সাকে পাল্টেছেন…প্রথম বছর তিনি কিছু করেননি, কিন্তু লোকে তাঁকে ভালোবেসেছে। ট্রফি আসতে শুরু হওয়ার পর সবাই সুখী হয়েছে। বার্সার সব সময় কৃতজ্ঞ থাকা উচিত তাঁর প্রতি।’

শুধু বার্সা কেন, কৃতজ্ঞ আসলে সব ফুটবলপ্রেমীই। যে দলেরই সমর্থক হন না কেন, মাঠে বল পায়ে রোনালদিনিওকে আপনার ভালোবাসতেই হবে। একটা লোক, শুধু পা নয়, মাথা, বুক, পিঠ, কাঁধ, ঘাড়—সবকিছু ব্যবহার করে বলকে নিজের সন্তানের মতো নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন হাসতে হাসতে, সেখানে যাঁরা বাধা সৃষ্টি করতে আসেন, তাঁরাও লোকটার আনন্দময় ছলাকলায় বোকা বনে শিশুর মতো হাসেন। যেমনটা হাসলেন সিডর্ফ, ফিগো কিংবা বোয়োর। কিংবা আপনি নিজেও।

রোনালদিনিও সেই হাসি ছড়িয়েই ফ্রি–কিকে ৬৬ গোল করেছেন। কিন্তু তাঁর গোলসংখ্যা কে মনে রাখে! গোলগুলো কীভাবে হলো, কীভাবে খেলল, সে জাদুগুলোই মনের মুকুরে আম্র-মুকুলের মতো সুবাস ছড়ায় প্রতিনিয়ত। কারণ, মাঠে হাসিমুখে ফুটবলকে কথা বলানোর মতো সুন্দর দৃশ্যের তুলনা পৃথিবীতে আছে খুব সামান্যই। একটা ফ্রি–কিক যেন একটা ফাঁকা ক্যানভাস। শিল্পীদের তুলির অসামান্য আঁচড়ে সেটাই হয়ে ওঠে মিকেল অ্যাঞ্জেলো, রাফায়েল, ভ্যান গঘ কিংবা রোনালদিনিওর ‘চিত্রকর্ম’!

এসব চিত্রকর্মের পেছনের কারণটা সাত বছর আগে ‘দ্য প্লেয়ার্স ট্রিবিউন’–এ নিজের শৈশবের কাছে লেখা চিঠিতে নিজেই বলেছিলেন রোনালদিনিও, ‘যতক্ষণ তোমার পায়ে বল, ততক্ষণ তুমি মুক্ত পাখি। পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। অনেকটাই পছন্দের গান শোনার মতো। সেই অনুভূতিতে ডুবে তুমি নিজের ভেতরকার সবটুকু সুখ সবার মাঝে ছড়িয়ে দিতে চাইবে।’

যে জাদুকর এভাবে বিশ্বময় সুখ ছড়িয়ে দিতে পারেন, তাঁর ভেতরটা কিসে গড়া, সেটাও নিশ্চয়ই আপনার জানতে ইচ্ছা করে? শুনুন তোস্তাওয়ের মুখে, ‘রোনালদিনিওর ড্রিবলিং রিভেলিনোর মতো, দূরদর্শিতা গারসনের, স্পিরিট ও আনন্দ গারিঞ্চার, গতি, দক্ষতা ও শক্তি জর্জিনিও ও রোনালদোর, কৌশলগত দক্ষতা জিকোর এবং সৃষ্টিশীলতা রোমারিওর।’কিন্তু সবচেয়ে বড় দক্ষতাটাই মাত্র ২৭ বছরে অবসর নেওয়া ব্রাজিলিয়ান কিংবদন্তি বলেননি—রোনালদিনিও আপনার মুখে হাসি ফোটাতে জানেন।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য