Thursday, January 23, 2025
বাড়িজাতীয়ভারতের অর্থনৈতিক ‘মিরাকলের’ ভেতরে যে ‘টাইম বোমা’

ভারতের অর্থনৈতিক ‘মিরাকলের’ ভেতরে যে ‘টাইম বোমা’

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক,,২৯ মে: স্বপ্ন পূরণের জন্য যে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে, সেটা বেশ ভালোভাবেই জানেন সুনীল কুমার। ভারতের হরিয়ানার ২৮ বছর বয়সী এই যুবকের ব্যাচেলর ও মাস্টার্স ডিগ্রি রয়েছে, এখন আরেকটি ডিগ্রির জন্য শ্রম দিচ্ছেন। এসব কিছু তিনি করছেন বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল এ অর্থনীতির দেশে ভালো বেতনের একটি চাকরির জন্য।সিএনএনকে সুনীল বলেন, “আমি পড়ালেখা করেছি যাতে জীবনে সফল হতে পারি। কেবল কঠোর পরিশ্রম করলেই আপনি চাকরি পেতে সক্ষম হবেন।”সুনীলের এখন একটি চাকরি আছে, তবে তার পড়ালেখার উদ্দেশ্য এই চাকরির জন্য নয়; আর যে চাকরির স্বপ্ন তিনি দেখেন, সেটি তো নয়ই।গত পাঁচ বছর তিনি তার গ্রামের একটি স্কুলের মেঝে ঝাড়ু দিয়েছেন। পাশপাশি অল্পবয়সী শিশুদের পড়িয়েছেন। সব মিলিয়ে প্রতি মাসে তার যে আয় হয়, বাংলাদেশি মুদ্রায় তার পরিমাণ ১০ হাজার টাকার কম।   সুনীল জানান, এই উপার্জন খুব বেশি কিছু নয়। বিশেষ করে তার বৃদ্ধ বাবা-মা ও এক বোনকে দেখতে হয়। কিন্তু তার সামনে এখন উপার্জনের এ পথই কেবল রয়েছে।তার কথায়, একজন শিক্ষক হয়ে ডিগ্রিগুলো কাজে লাগানোর কথা ছিল তার। কিন্তু তার বদলে নিজের পেট চালাতে তাকে কায়িক শ্রমও দিতে হচ্ছে।

সিএনএন লিখেছে, সুনীলের এই হাল ভারতের জন্য নতুন কিছু নয়, দেশটির লাখ লাখ তরুণের দুর্দশার চিত্র এটি। ভারতে যুব বেকারত্ব তীব্রভাবে বেড়ে চলেছে, যা দেশটির অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির মুহূর্তে ঝুঁকি তৈরি করছে।চীনের জনসংখ্যা কমে বয়স্ক জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের সবচেয়ে জনবহুল দেশ হিসেবে ভারতের নতুন অবস্থান বিশ্ব অর্থনীতিতে তরুণ শক্তির আশা জাগিয়েছে। ভারতের কর্মক্ষম জনসংখ্যা বয়সে তুলনামূলকভাবে তরুণ, যাদের সংখ্যা বাড়ছে এবং আগামী দশকে তা একশ কোটিতে পৌঁছাতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এই বিপুল শ্রমশক্তি এবং বিশাল বাজারকে ‘অর্থনৈতিক মিরাকল’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের এক কর্মকর্তা।কিন্তু সুনীল কুমারের মত ভারতীয় তরুণদের জন্য তথাকথিত এই মিরাকলের আরেকটি দিক আছে, সেখানে চাকরি খুবই কম এবং প্রতিযোগিতা তীব্র।

মিরাকল থেকে হতাশা

অর্থনীতিবিদের শঙ্কা, চীনের ক্রমবর্ধমান বয়স্ক জনসংখ্যাকে দেখার জন্য সেখানে পর্যাপ্ত কর্মী থাকবে না; কিন্তু ভারতের বিষয়ে তাদের উদ্বেগ হল, ক্রমবর্ধমান শ্রম শক্তিকে কাজে লাগানোর জন্য পর্যাপ্ত চাকরি সেখানে নেই।সিএনএন জানিয়েছে, ভারতের মোট জন সংখ্যার ৪০ শতাংশের বেশির বয়স ২৫ এর নিচে। মুম্বাইভিত্তিক গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর মনিটরিং ইন্ডিয়ান ইকোনমির ২০২২ সালের ডিসেম্বরের হিসাবে, এই তরুণ জনসংখ্যার প্রায় অর্ধেক (৪৫.৮%) বেকার।মাস্টার্স ডিগ্রিধারী সুনীল কুমার গ্রামের একটি স্কুলে ঝাড়ুদারের কাজ করেন, পাশপাশি অল্পবয়সী শিশুদের পড়ান। |সিএনএনকে কিছু অর্থনীতিবিদ এই পরিস্থিতিকে ‘টাইম বোমা’ হিসেবে অভিহিত করেছেন, যেখানে চাকরির বাজার তৈরি করা না গেলে সামাজিক অস্থিরতা তৈরি হতে পারে বলে তারা সতর্ক করেছেন।কাজের অভাব থেকে তৈরি হতাশাকে খুব ভালোভাবে বুঝতে পারেন সুনীল ও তার মত অন্যরা। সিএনএনকে সুনীল বলেন, “যোগ্যতা আর শিক্ষা থাকা সত্ত্বেও আমার ভালো কোনো চাকরি নেই বলে রেগে যাই। এর জন্য আমি সরকারকেই দোষারোপ করি। সরকারের উচিত তার জনগণের জন্য উপযুক্ত কাজের ব্যবস্থা করা।”

ভারত সরকার ও কুমারের মত অন্যদের জন্য খারাপ খবর হল, দেশটির জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে চাকরির প্রতিযোগিতা আরও বেড়ে গেলে এ সমস্যা আরও খারাপের দিকে যাবে বলে আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।যুক্তরাষ্ট্রের কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ভারত সরকারের প্রাক্তন প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা কৌশিক বসুর ভাষায়, ভারতে যুব বেকারত্বের হার ‘বিস্ময়করভাবে বেশি’। “দীর্ঘদিন ধরে এই বেকারত্বের হার ধীরে ধীরে বেড়েছে। প্রায় ১৫ বছর ধরে এটি ধীরগতিতে বেড়েছে, কিন্তু গত সাত-আট বছরে এটি তীব্রভাবে বেড়েছে।”তিনি বলেন, “যদি এই শ্রেণির মানুষ যথেষ্ট কাজ খুঁজে না পায়, তাহলে যে তরুণ জনসংখ্যাকে আমরা এখন সুবিধা বলছি, সেটাই ভারতের জন্য বিশাল চ্যালেঞ্জ ও সমস্যার কারণ হয়ে উঠবে।”

সবক্ষেত্রে প্রতিযোগিতা

অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ভারতের তরুণ জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং বেকারত্বের হার বাড়ার ঘটনা কেবল যে হতাশার বিষয়, তেমন নয়।জনসংখ্যাতাত্ত্বিক সমস্যাগুলো মোকাবেলা করার নানা ধরনের সুযোগ ভারতের রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে বিশ্ব বাজারে প্রতিযোগিতায় সক্ষম ক্রমবর্ধমান উৎপাদন খাত। ক্যাপিটাল ইকোনমিক্স বলছে, এই খাতে ২০২১ সালে ১৫ শতাংশের কর্মসংস্থান হয়েছে, যা তুলনামূলকভাবে কম।

শ্রমঘন শিল্পে কর্মসংস্থানের আরো সুযোগ তৈরি করা যায়, কিন্তু যারা কঠোর পরিশ্রম করে নিজেদের যোগ্য করে তুলছেন, তাদের জন্য শ্রমঘন উৎপাদন খাত বড় কোনো সুযোগ তৈরি করতে পারবে না।১৭ বছর বয়সী মেঘা কুমারী উত্তরাঞ্চলীয় রাজ্যের শহর কোটার ভাইব্রেন্ট অ্যাকাডেমিতে পড়ালেখা করছেন। হাই স্কুলে পড়ার জন্য নিজ শহর ঝাড়খণ্ডের দুমকা ছেড়েছেন তিনি। দুমকা থেকে কোটার দূরত্ব ১৩০০ কিলোমিটারের বেশি।ওই অ্যাকাডেমি ভারতের সেই সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের একটি, যেখানে শিক্ষার্থীরা পরবর্তীতে সেরা কলেজের ভর্তির জন্য প্রস্তুত হতে স্কুলের নিয়মিত বাড়তি কারিকুলামে অংশ নিয়ে থাকে। শিক্ষার্থীরা অতিরিক্ত পরীক্ষা, প্রস্তুতিমূলক কোর্স ও টিউটরিং সেশনে যোগ দেয়।মেঘা কুমারী অধ্যাপক হওয়ার স্বপ্ন দেখে। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে তার স্কুলের কার্যক্রমকে সর্বোচ্চ সুযোগ হিসাবে দেখে সে। তবে স্বপ্ন বাস্তবায়নে ব্যক্তিগতভাবে এবং আর্থিভাবে অনেক হিসাব-নিকাশেরও ব্যাপার আছে।সর্বশেষ সরকারি হিসাবে, ভারতে নিয়মিত পূর্ণঘণ্টা কাজ করা ব্যক্তিদের মাসিক গড় বেতন প্রায় ২২৫ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৫ হাজার টাকার কম)। সেখানে ওই অ্যাকাডেমিতে এক বছরের টিউশন ফিই লাগে ১৪৫ থেকে ১ হাজার ৮৭২ ডলার (বাংলাদেশি মুদ্রায় ১৫ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা)।

মেঘা কুমারী সিএনএনকে বলেছে, “পরিস্থিতি খুবই প্রতিযোগিতাপূর্ণ। একা পরিবার থেকে দূরে থাকা এবং এই সমস্ত চাপের মধ্য দিয়ে যাওয়া একজন শিক্ষার্থীর পক্ষে কঠিন।”মেঘা কুমারীর যে অবস্থা, সেটাও ভারতীয়দের কাছে জন্য খুব অপরিচিত কিছু নয় বলে জানিয়েছে সিএনএন।“শৈশব থেকেই আমরা এমন প্রতিযোগিতার মুখোমুখি হয়ে আসছি”, বলেন ২৮ বছর বয়সী সারাং আগরওয়াল, যিনি ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের প্রবেশিকা পরীক্ষার জন্য পড়ালেখা করছেন।তার কথায়, “ভারতে প্রত্যেক পরীক্ষায় প্রতিযোগিতা আছে, প্রতিযোগিতা সব জায়গায়।”সুনীল কুমার ও মেঘা কুমারীর মত আগরওয়াল প্রতিযোগিতার সবকিছু ভালোভাবেই জানেন। একটি ভালো চাকরির জন্য প্রতি বছর ভারতের সিভিল সার্ভিস পরীক্ষায় অন্য ১০ লাখ প্রার্থীর মতো তিনিও আবেদন করেছেন।ভারতে সরকারি চাকরি শিক্ষার্থীদের কাছে সবথেকে বেশি প্রত্যাশিত, যদিও তাতে সাফল্য পান আবেদনকারীর ১ শতাংশেরও কম।

সরকারি চাকরির এই পরীক্ষা ঘিরে রীতিমত একটি শিল্প গড়ে উঠেছে, যারা চাকরিপ্রার্থীদের সেই ‘সোনার টিকেট’ ধরতে সাহায্য করেন।টিউশন সেন্টার ‘স্টাডি আইকিউ’ এর পরিচালক মধুসূদন বলেন, “জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে প্রতিযোগিতাও বেড়েছে। ফলে মানুষের সুযোগও কমে গেছে।”ভারতীয় তরুণরা এই চাপ ভালোভাবেই বুঝতে পারছেন বলে মনে করেন তিনি।মধুসূদন বলেন, “শিক্ষার্থীদের মধ্যে আজকাল মানসিক চাপের মাত্রা অনেক বেশি। ছাত্ররা আমার কাছে এসে বলে, ‘স্যার, আমি ঘুমাতে পারি না’।”এই চাপ সামলানোর জন্য খুব বেশি সময় এই শিক্ষার্থীদের হাতে নেই। তাদের কোনো সামাজিক জীবন নেই, নেই প্রেম। আপাতত শুধু একটি লক্ষ্যই তাদের সামনে আছে।সারাং আগরওয়াল চারবার সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা দিয়েও সফল হতে পারেননি। কিন্তু তার এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে তার পরিবারকে বছরে প্রায় আড়াই লাখ রুপি ব্যয় করতে হচ্ছে।তিনি বলেন, “আমার জন্য খরচ করা অর্থ দিয়ে তারা চারটি গাড়ি কিনতে পারত। এখন চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আরা কোনো বিকল্প নেই। কোনো প্ল্যান বি-ও নেই।”

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য