Wednesday, May 21, 2025
বাড়িখেলাঅমরত্বের নাম জোকোভিচ

অমরত্বের নাম জোকোভিচ

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ৫ আগস্ট: ম্যাচ শেষ হওয়ার পর দীর্ঘ উদযাপন, পুরষ্কার বিতরণী আয়োজন, একের পর এক চ্যানেলে প্রতিক্রিয়া জানানো, সব মিলিয়ে পেরিয়ে গেল অনেকটা সময়। নির্ধারিত সময়ের কিছুক্ষণ পর সংবাদ সম্মেলনে এলেন নোভাক জোকোভিচ। তিনি কক্ষে পা রাখতেই তুমুল করতালিতে তাকে স্বাগত জানালেন সংবাদকর্মীরা। তার গায়ে জড়ানো দেশের পতাকা, গলায় ঝোলানো সূর্যের হাসির মতো সোনালি পদক আর চোখে-মুখে গৌরব ও তৃপ্তির দীপ্তি।

পরের সময়টুকুতে তিনি যেন মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখলেন গোটা জনাকীর্ণ সংবাদ সম্মেলনে থাকা সবাইকে। কোর্টে যেমন চোখধাঁধানো টেনিসের প্রদর্শনীতে মুগ্ধতা ছড়িয়েছেন এ দিন, তেমনি মাইক্রোফেনের সামনেও কথার ইন্দ্রজালে বুঁদ করে রাখলেন সবাইকে।যে পদকের অভিযান তিনি শুরু করেছিলেন ১৬ বছর আগে, অনেক পথ পেরিয়ে, দীর্ঘ যন্ত্রণাময় অপেক্ষার পর, বারবার হৃদয় ভাঙার বেদনা সয়ে অবশেষে এবার সেই স্বর্ণালী আভায় নিজেকে রাঙাতে পারলেন তিনি ৩৭ বছর বয়সে এসে।পরম আরাধ্য কিছু পাওয়ার তৃপ্তি বারবার ফুটে উঠল তার কথায়। সেখানে মিলেমিশে একাকার দেশপ্রেম। দেশের প্রতি তীব্র অনুরাগ ফুটে উঠল তার কণ্ঠে আর অনুভূতিতে। তার স্বস্তি, তার ভালো লাগা, পরিণত মানসিকতা, এই প্রাপ্তির ওজন, ভবিষ্যৎ ভাবনা, টেনিস ছাড়িয়ে গভীর জীবনবোধ… কতকিছু যে ফুটে উঠল তার কথায়!

ক্যারিয়ারে অনেকবারই টেনিস কোর্টে দারুণ মজার সব কাণ্ডে তিনি উপহার দিয়েছেন নির্মল বিনোদন। এ দিন সংবাদ সম্মেলনেও সেই রেশ ছড়ালেন। ভবিষ্যতে সার্বিয়ার প্রেসিডেন্ট হতে চান কি না, এমন প্রশ্নে রসিকতা করলেন। চার বছর পরের অলিম্পিকে খেলার সম্ভাবনা নিয়েও কৌতুক করলেন। জীবনের প্রথম এটিপি ট্রফি জিতে পুরস্কার পেয়েছিলেন একটি আইপড। সেই স্মৃতি মনে করে বললেন, “আইপড জেতা আর অলিম্পিকস সোনা জয়ের মধ্যে খানিকটা পার্থক্য আছে মনে হয়!” এছাড়াও আরও কয়েকবার হাসলেন। হাসালেন।ফাইনালে যাকে হারিয়েছেন তিনি, সেই তরুণ কার্লোস আলকারাসকে প্রশংসায় ভাসালেন বেশ কয়েকবার। অকপটেই বললেন, ২১ বছর বয়সী এই স্প্যানিশই হয়তো এখন বিশ্বের সেরা টেনিস খেলোয়াড়।

তার দীর্ঘ সংবাদ সম্মেলনে সবচেয়ে বেশি যেটা ফুটে উঠল, তা হলো বিনয়। এক ভারতীয় সংবাদকর্মী একটি প্রশ্ন করলেন, যেটির উত্তর জোকোভিচ আগেই দিয়েছেন। তবু বিরক্ত না হয়ে তিনি বললেন, “যদিও উত্তরটা আগেই দিয়েছি, তবে আরেকবার বলতে আমার মোটেও আপত্তি নেই…”, এটুকু বলে বিশদ উত্তর দিলেন আবার।এছাড়াও আরও কতভাবেই যে বিনয়ের প্রকাশ দেখা গেল তার কথায়! আরও একবার প্রমাণ হলো, যে যত বড় চ্যাম্পিয়ন, সে ততটাই বিনয়ী। টেনিস ইতিহাসের সফলতম খেলোয়াড় তিনি, প্রাপ্তির পূর্ণতায় এ দিন ছুঁয়ে ফেললেন আকাশ।\

 কিন্তু অসাধারণরকম সাধারণভাবে তার পা একদম মাটিতে।দেশের পতাকা যেমন তার গায়ে জড়ানো, তেমনি দেশকে তিনি ধারণ করেন একদম হৃদয়ের গভীরে। দেশের জন্য অলিম্পিক সোনা জয়ের কী প্রবল আকুতি যে তার ছিল! আগে চারবার অলিম্পিকস খেলে তার প্রাপ্তি ছিল কেবল একটি ব্রোঞ্জ। সেটিও সেই ২০০৮ সালে। পরে তিনবার তিনি আটকে গেছেন সেমি-ফাইনালে। ব্রোঞ্জের লড়াইয়েও হেরে গেছেন প্রতিবার।সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি ছিল সম্ভবত গত আসরে। ২০২১ সালে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন ও উইম্বলডনে টানা শিরোপা জিতে টোকিও অলিম্পিকসে গিয়েছিলেন তিনি। সেমি-ফাইনালে উঠে গিয়েছিলেন তরতর করে। সেখানেও প্রথম সেটে প্রবল দাপটে জয়ের পর টানা দুই সেটে হেরে অভাবনীয়ভাবে ম্যাচ হেরে বসেন। এরপর ব্রোঞ্জের লড়াইয়েও হেরে যান। একই পঞ্জিকাবর্ষে চার গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের সঙ্গে অলিম্পিকস জয়ের ‘আল্ট্রা-এক্সক্লুসিভ গোল্ডেন স্ল্যাম’ জয়ের অনন্য কীর্তি গড়ার স্বপ্ন ভেস্তে যায় তার।

এমনকি সেবার পরে ইউএস ওপেনের ফাইনালে হেরে গিয়ে ‘ক্যালেন্ডার গ্র্যান্ড স্ল্যাম’ জিততেও পারেননি।এবার সেমি-ফাইনালে জেতার পর তাকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, ‘রুপা জিতলে কি সন্তুষ্ট থাকবেন?’ তিনি স্রেফ বলেছিলেন, ‘নেক্সট কোয়েশ্চেন…।’ যেটির মানে, এসব তিনি শুনতেই চাননি। সোনা জয় ছাড়া আর কিছু তার ভাবনায় ছিল না।অবশেষে আগের সব হতাশা আর দুঃস্বপ্নকে এবার তিনি মাটিচাপা দিতে পারলেন। ক্যারিয়ারের এই গোধূলি বেলায় তার পারফরম্যান্সে দেখা গেল মধ্যগগণের তেজ। গোটা টুর্নামেন্টে ছয় ম্যাচে একটি সেটও না হেরে ফাইনালেও প্রায় নিখুঁত পারফরম্যান্স মেলে ধরলেন। ইতিহাসের পঞ্চম খেলোয়াড় হিসেবে জিতলেন চারটি গ্র্যান্ড স্ল্যাম ও অলিম্পিকস জয়ের ‘গোল্ডেন স্ল্যাম।’তবে এই জয়ই তার হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের, কারণ তার হৃদয়জুড়ে আছে জন্মভূমি সার্বিয়া! টেনিসের বিশ্ব আঙিনায় এমনিতে ব্যক্তির জয়গানই গাওয়া হয়। ডেভিস কাপ বা এই ধরনের গেমস, এসব কিছু আসরে দেশের হয়ে খেলোয়াড়রা নামেন বটে, কাগজে-কলমে সেসবের মর্যাদাও আছে, তবে বাস্তবে গুরুত্ব ও জনপ্রিয়তা খুব একটা নেই। অলিম্পিকস সোনাকেই তো অনেকে খুব একটা উঁচুতে রাখেন না টেনিসে।

তবে জোকোভিচ যে এখানে আলাদা, তা স্পষ্ট করে দিলেন এ দিন। ২৪টি গ্র্যান্ড স্ল্যাম জয়ের অবিশ্বাস্য কীর্তি আছে তার। ৭ বার জিতেছেন এটিপি টুর ফাইনালস। দেশের হয়ে ডেভিস কাপ, হপম্যান কাপ জিতেছেন। আরও কতশত রেকর্ড-অর্জন-ট্রফিতে সমৃদ্ধ তার ক্যারিয়ার। কিন্তু যখন জিজ্ঞেস করা হলো অলিম্পিক সোনা জয়ের অর্জনকে কোথায় রাখবেন, এক মুহূর্তও ভাবতে হলো না তাকে।“এটিই সবচেয়ে স্পেশাল। আজকের আগ পর্যন্ত আমার ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত ছিল লন্ডনে ২০১২ অলিম্পিকসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সার্বিয়ার পতাকা বয়ে নেওয়া। একজন অ্যাথলেটের জন্য সবচেয়ে সেরা মুহূর্ত দেশের পতাকা বয়ে নেওয়া। কিন্তু আজকে যা পেয়েছি… এতদিন যত কিছু আমার কল্পনায় ছিল, যত কিছু আশা করেছি, যা কিছু চেয়েছি, সব ছাড়িয়ে গেছে তা।”

“সার্বিয়ার পতাকা উড়ছিল, সোনার পদক গলায় নিয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইছিলাম, পেশাদার ক্রীড়ায় এই চেয়ে ভালো কোনো অনুভূতি আর হতে পারে না। আমি আকাশে উড়ছি।”সোনা জয়ের পর কোর্টে তার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়াতেও মিশে ছিল দেশের জন্য কিছু করতে পারার সুখ, “এই সোনা জয়ের জন্য আমি মন-প্রাণ ও সবকিছু উজাড় করে দিয়েছি। দেশের জন্য এটা করেছি আমি, সার্বিয়ার জন্য।”এমনিতে সময়টা তার ভালো যাচ্ছিল না খুব একটা। এই বছরে কোনো শিরোপা জিততে পারেননি এটির আগ পর্যন্ত। সেখান থেকে যেভাবে এই সোনা জিতলেন, এত এত গ্র্যান্ড স্ল্যাম ট্রফি আর অর্জনের ভীড়ে এটিকেই তিনি বলছেন ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য।

“আমার প্রথম অলিম্পিকে (২০০৮) ব্রোঞ্জ জিতেছিলাম। এরপর পদক জিততে ব্যর্থ হয়েছি। চারবারের মধ্যে তিনবারই সেই প্রতিবন্ধকতা পার হতে পারিনি, সেমি-ফাইনালে হেরে গেছি। অলিম্পিকস আস চার বছর পরপর। দেশের হয়ে সোনা জয়ের সুযোগটি তার বিরল। আমি জানি, বয়স ৩৭ হয়ে গেছে, আর সুযোগ খুব একটা পাব না।” “এখন এই ৩৭ বছর বয়সে এসে, ২১ বছর বয়সী একজনের সঙ্গে, এই মুহূর্তে যে সম্ভবত বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়, কিছু আগেই যে রোলাঁ গাঁরোয় ও উইম্বলডনে জিতেছি এবং সম্প্রতি অসাধারণ টেনিস খেলছে, তার সঙ্গে এমন জয়… জানতাম তাকে হারাতে সর্বোচ্চ চূড়া ছুঁতে হবে। সবকিছু বিবেচনায় নিলে এটিই সম্ভবত আমার ক্যারিয়ারের সেরা সাফল্য।”

অলিম্পিকস সোনা জয়ের পর তার ক্যারিয়ারে দৃশ্যত কোনো অপূর্ণতা আর নেই। ক্যারিয়ার এখন ‘কমপ্লিট’ কি না, এই প্রশ্নে অবশ্য তার উত্তরে মিশে থাকল দুটি দিক। ক্যারিয়ারকে তিনি পূর্ণ মনে করছেন বটে, তবে তার ক্ষুধা এখনও কমেনি খুব একটা।“(ক্যারিয়ার পূর্ণ কি না) হ্যাঁ এবং না…। হ্যাঁ, ক্যারিয়ার পূর্ণ, কারণ এই সোনা দিয়ে সব অর্জন হয়ে গেল আমার। তবে ‘না’ বলছি কারণ, আমি খেলাটাকে ভালোবাসি। স্রেফ টুর্নামেন্ট জয়ের জন্য খেলি না আমি। আমি খেলি কারণ খেলতে ও লড়তে ভালোবাসি। প্রতিদিন, প্রতি সপ্তাহে যে তাড়না, অনুশীলন করা, শরীরকে তৈরি রাখা, উন্নতি করা, সবকিছু ভালোবাসি। খেলাটা আমাকে এত কিছু দিয়েছে, আমিও যতটা সম্ভব ফিরিয়ে দিতে চাই।”

“এখনও যে কোনো তরুণ খেলোয়াড়ের মতোই পরিশ্রম করি আমি। আপনাকে সেই নিশ্চয়তা দিতে পারি। যতটা সম্ভব পরিশ্রম করি। এরকম সাফল্য তাই কাকতালীয় নয়। অনেক কষ্টের ফসল এসব।”ক্যারিয়ারের ভবিষ্যত সময়ের হাতেই তুলে রাখলেন তিনি। আপাতত তিনি কেবল উদযাপন করতে চান এক জীবনের স্বপ্ন পূরণ হওয়ার এই মুহূর্তটুকু।“সত্যি বলতে, ভবিষ্যৎ জানা নেই আমার। আমি আপাতত বর্তমানে থাকতে চাই। উদযাপন করতে চাই। এই মুহূর্তটির জন্য অনেক কষ্ট করেছি, অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছি। অনেক বছরের অনেক লম্বা ভ্রমণে অনেক অনেক স্বপ্ন ছিল এই সোনার পদকের ছোঁয়া পাওয়া। এখন তাই সময়টা আনন্দের, খুশি ও উদযাপনের।”উদযাপন করছে আসলে গোটা টেনিস বিশ্বই। তার এই জয় যে খেলাটিরই জয়!

সম্পরকিত প্রবন্ধ

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য

error: <b>Alert: </b>Content selection is disabled!!