স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক, ৬ জানুয়ারি: ১৯৫৮ সালে ব্রাজিলের প্রথম বিশ্বকাপজয়ী দলে খেলেছেন এই লেফট উইঙ্গার। ফাইনালে নিজে গোল করার পাশাপাশি বানিয়ে দিয়েছেন পেলের গোল। পরের বিশ্বকাপে শিরোপা ধরে রাখা দলেরও গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিলেন তিনি।১৯৭০ সালে তার কোচিংয়েই ব্রাজিল জেতে আরেকটি শিরোপা। পেলে, জাইরজিনিয়ো, রিভেলিনো, তোস্তাওদের সেই দলকে মনে করা হয় ফুটবল ইতিহাসের সেরা দল।ফুটবলার ও কোচ, দুই ভূমিকায় বিশ্বকাপ শিরোপা জয়ের ইতিহাস রচনা হয় তার হাত ধরেই।পরে ২৪ বছরের খরা ঘুচিয়ে ১৯৯৪ বিশ্বকাপে শিরোপাজয়ী ব্রাজিল দলের সহকারী কোচ ছিলেন জাগালো।এছাড়াও ১৯৭৪ বিশ্বকাপে তার কোচিংয়ে চতুর্থ হয় ব্রাজিল, ১৯৯৮ বিশ্বকাপে তার কোচিংয়ে হয় রানার্স আপ। ২০০৬ বিশ্বকাপে তিনি ছিলেন ব্রাজিলের টেকনিক্যাল অ্যাসিস্ট্যান্ট।এমনকি ১৯৫০ বিশ্বকাপ ফাইনালেও তিনি মাঠে ছিলেন। তবে সেবার ভিন্ন ভূমিকায়, নিরাপত্তাকর্মী হিসেবে।১৯৯২ সালে ‘ফিফা অর্ডার অব মেরিট’ সম্মাননা পান তিনি, বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্তা সংস্থাটির সর্বোচ্চ খেতাব যা। ২০১৩ সালে ওয়ার্ল্ড সকার ম্যাগাজিনের দৃষ্টিতে তাকে মনোনীত করা হয় সর্বকালের নবম সেরা কোচ হিসেবে।
নামের অংশ থেকে মিলিয়ে তাকে ডাকা হতো ‘ওল্ড উল্ফ’ নামে। তবে কোচ হিসেবে তার দুর্দান্ত ট্যাকটিকস, টেকনিক্যাল জ্ঞান ও ডাগআউটে ব্যক্তিত্বময় উপস্থিতির কারণে ফুটবলারদের কাছে তার পরিচিতি ছিল ‘দা প্রফেসর’ নামে।ফুটবল মাঠে কীর্তির কারণে তিনি তুমুল জনপ্রিয় তো ছিলেনই, তবে ব্রাজিলিয়ানরা তাকে ভালোবাসত ও লালন করত তার স্বকীয় ব্যক্তিত্ব ও আপোসহীন দেশপ্রেমের কারণে। তিনি সবসময় বলতেন, তার জন্মই হয়েছে জয়ের জন্য। কখনও তিনি ছিলেন খেয়ালি, কখনও মেজাজি। নিজেকে আলাদা করে ফুটিয়ে তুলেছেন সবসময়ই। এতেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আদর্শ একজন।১৯৩১ সালের ৯ অগাস্ট তার জন্ম ব্রাজিলের উত্তরপূর্বাঞ্চলের দরিদ্র উপকূলীয় এলাকা আতালালিয়ার মাসেইয়োতে।
পুরো নাম মারিও জর্জে লোবো জাগালো। ‘লোবো’ শব্দের অর্থ ‘উল্ফ’, সেখান থেকেই এসেছে তার ‘ওল্ড উল্ফ’ ডাক নামটি।তার শৈশবের স্বপ্ন ছিল পাইলট হওয়ার। তবে চোখের সমস্যার কারণে সেই স্বপ্ন বিসর্জন দিতে হয় তাকে। পরে হিসাবরক্ষণ নিয়ে পড়াশোনা করেন, পাশাপাশি ফাঁকা সময়ে ফুটবল খেলতেন। সেভাবে খেলেই একসময় জায়গা করে নেন তার শহরের সবচেয়ে বড় ক্লাবে। তিনি অনেকবারই বলেছেন, তার জীবনে ফুটবল এসেছে দুর্ঘটনাক্রমে।পরিবারের বাধা পেরিয়ে, নানা পথ মাড়িয়ে একসময় তিনি ফুটবলারই হয়ে ওঠেন। নাম লেখান ব্রাজিলের সবচেয়ে বড় ক্লাবগুলির একটি ফ্লামেঙ্গোতে। এই দলের হয়ে রাজ্য চ্যাম্পিয়নশিপ জেতেন তিন বার। ক্যারিয়ারের পরের ভাগে তিনি পাড়ি জমান প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাব বতাফোগোয়। সেখানেও জেতেন দুটি রাজ্য শিরোপা।ছোটখোটো গড়নের ছিলেন তিনি। শারীরিক ঘাটতি পুষিয়ে দিতেন ট্যাকটিক্যাল মেধা দিয়ে। আক্রমণের পাশাপাশি রক্ষণেও দারুণ ভৃমিকা রাখতেন বলে কোচের কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ অংশ করে তুলেছিলেন নিজেকে। নানা সময়ে ক্লাবের হয়ে মূল স্ট্রাইকার, ইনসাইড ফরোয়ার্ড হিসেবেও খেলেছেন তিনি।
১৯৫৮ বিশ্বকাপকে পেলের উত্থানের আসর হিসেবে ধরা হলেও ব্রাজিলের জয়ে জাগালোরও ছিল যথেষ্ট অবদান। ১৯৬২ বিশ্বকাপে সব ম্যাচে প্রতিটি মিনিট খেলেন তিনি। সেবার দলের কৌশলে পরিবর্তন আনা হয় জাগালোকে দিয়েই। অনেকটাই নিচে নেমে প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দেওয়ায় সহায়তা করতেন তিনি, এরপর গুলির বেগে উঠে যেতেন আক্রমণে। বলা হয়, ফরোয়ার্ডদের রক্ষণে নেমে সহায়তা করার ব্যাপারটি ব্যপকভাবে চালু হয়েছিল তার মাধ্যমেই।ব্রাজিলের হয়ে শেষ ম্যাচ খেলেন তিনি ১৯৬৪ সালে। পরের বছর বিদায় নেন ক্লাব ফুটবল থেকেও। এর পরের বছরই কোচিং ক্যারিয়ার শুরু করেন বতাফোগোর হয়ে।১৯৭০ সালে সেই সময়ের কোচ জোয়াও সালদানিয়ার বিতর্কিত বিদায়ের পর বিশ্বকাপের মাত্র কিছুদিন আগে কোচের দায়িত্ব দেওয়া হয় জাগালোকে। বিশ্বকাপের আগে ব্রাজিলের ফর্ম খুব আশা জাগানিয়া ছিল না। তবে প্রতিভাবান ও তারকায় ভরা দলটিকে এক সুতোয় গেঁথে দারুণ কৌশলে খেলানোর কৃতিত্ব দেওয়া হয় জাগালোকেই। তৃতীয় বিশ্বকাপ শিরোপা জিতে ইতিহাস গড়ে ব্রাজিল।১৯৭৪ বিশ্বকাপে চতুর্থ হওয়ার পর জাতীয় দল ছেড়ে ক্লাব কোচিংয়ে ফেরেন তিনি। ব্রাজিলিয়ান ফুটবলে কোচিংয়ের পাশাপাশি নানা সময়ে কুয়েত, সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাতের কোচের দায়িত্ব পালন করেন।
কোচ হিসেবে তার গ্রহণযোগ্যতার কারণেই ১৯৯৪ সালে আবার ব্রাজিলের কোচিং স্টাফে যুক্ত করা হয় তাকে। দুই যুগ পর শিরোপার স্বাদ পায় তারা। ১৯৯৮ বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে ব্রাজিল তার কোচিংয়েই। সেবার ফ্রান্সের কাছে ৩-০ গোলে হেরে যায় তার দল। ফাইনালের কয়েক ঘণ্টা আগে অসুস্থ হয়ে পড়া রোনালদোকে মাঠে নামানো নিয়ে সমালোচনার শিকারও হতে হয় কোচ জাগালোকে।২০০২ বিশ্বকাপের পর কিছুদিন ভারপ্রাপ্ত কোচের দায়িত্বে ছিলেন তিনি। ২০০৩ থেকে ২০০৬ বিশ্বকাপ পর্যন্ত ছিলেন টেকনিক্যাল পরামর্শক। সেই বিশ্বকাপের পরই আনুষ্ঠানিকভাবে অবসর নেন কোচিং থেকে।তবে ফুটবল থেকে পুরোপুরি বিদায় নেননি। জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা তার বরাবরই ছিল। টিভিতে বিশেষজ্ঞ মতামত দিতে দেখা যায় তাকে, ফুটবলের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তার উপস্থিতি ছিল নিয়মিত, ব্রাজিলিয়ান ফুটবল কনফেডারেশন বিভিন্ন প্রয়োজনে তাকে পেয়েছে পাশে।এবার সব থেমে গেল। পেলে মারা যাওয়ার পর ১৯৫৮ বিশ্বকাপ ফাইনালজয়ী দলের একমাত্র জীবিত সদস্য ছিলেন জাগালোই। এখন আর বাকি রইল না কেউ।