Monday, June 2, 2025
বাড়িজাতীয়বাঙ্কার-জীবন যাপন করছেন মণিপুরের হাজার হাজার যুবক

বাঙ্কার-জীবন যাপন করছেন মণিপুরের হাজার হাজার যুবক

স্যন্দন ডিজিটেল ডেস্ক,   ০৭ এপ্রিল :  বয়স ২৫। বেকার যুবক। এক মাসের প্রশিক্ষণ অস্ত্রচালনায়। হাতে একনলা রাইফেল। যার ব্যারেলের গোড়ায় চিনা হরফ স্পষ্ট। জানালেন, আগে জীবন চলছিল উদ্দেশ্যহীন। এখন জীবনে উদ্দেশ্য, হাতে অস্ত্র, সমাজে সম্মান আর তিন বেলার খাবার—সবই মিলেছে। সব ঝামেলা মিটলে তিনি যোগ দিতে চান ফৌজে। ভোট? “দেব হয়তো। ঠিক নেই।”

বয়স ৩৫। শিক্ষক ছিলেন। চাকরি ছেড়ে আপাতত কুকি গ্রামরক্ষী বাহিনীর অন্যতম কমান্ডার। তিন মাসের প্রশিক্ষণ। একনলা, দোনলা, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, পিস্তল, মেশিনগান চালাতে পারেন সবই। সব ঝামেলা মিটলে ফের ছাত্র পড়াতে ফিরবেন। ভোট? “দেব। ইচ্ছে হলে।”

বয়স সাড়ে ১৮। উচ্চমাধ্যমিক দেওয়া হয়নি। সব পুড়েছে আগুনে। আপাতত দোনলা শটগান হাতে, সামরিক পোশাকে মোতায়েন সীমানা বাঙ্কারে। ঝামেলা মিটলে কী করবে ভেবে দেখেনি। ভোট? “নতুন ভোটার হয়েছিলাম। সেই কার্ড ও অন্য সবকিছু বাড়ির সঙ্গেই পুড়েছে। আগে ওদের আক্রমণ থেকে স্বভূমি বাঁচাই। পরে ভোট।”

এমনই বাঙ্কার-জীবন যাপন করছেন মণিপুরের হাজার হাজার যুবক, তরুণ। রাজ্যে ৬০ হাজারের বেশি মানুষ ১১ মাস ঘরছাড়া। ২৫ হাজার শিশুর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। হাতে হাতে অবাধে ঘুরছে বন্দুক। মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে বুলেটপ্রুফ ক্যাসপার। যুদ্ধক্ষেত্র মণিপুরে হিংসাকে ছাইচাপা দিয়ে রেখেছে ভোট।

কার্যত এক দেশের মধ্যে আর এক দেশ। তার মধ্যেও যেন আর এক দেশ! জাতীয় সড়কের দুই পাশে লেখা বিভাজনের স্লোগান। এখানে ভারত বিরোধিতা তো নয়ই, বরং কে বেশি ভারতীয় তা প্রমাণের মরিয়া প্রয়াস। তাই তো পাল্লেল হোক বা কোয়াকতা—তথাকথিত বাফার জ়োনের দুই পারে দেদার উড়ছে তেরঙা। মেইতেই ভূখণ্ডে কাংলেইপাকের সাতরঙা পতাকাও উড়ছে পাল্লা দিয়ে, ঘরে-ঘরে। প্রমাণের দায় রয়েছে, তাঁরাই আদি ও অকৃত্রিম ভূমিপুত্র। অনুপ্রবেশকারী হিসেবে দাগিয়ে দেওয়া কুকিরা শুধুই আঁকড়ে আছেন ভারতকে। তাই মনে শত রোষ জমলেও, ভারতবিরোধিতার লেশমাত্র নেই মুখে। নেই ভোট বয়কটের ডাক।

মণিপুরে যেতে লাগছে ইনারলাইন পারমিট। তা আবার কুকি এলাকায় গ্রাহ্য নয়। সেখানে নতুন পারমিটের ধাক্কা। দুই পক্ষের মধ্যে থাকা দু’কিলোমিটার বাফার এলাকায় ১০ বার চেকিং! আসাম রাইফেলস, সেনা, সিআরপিএফ, আইটিবিপি, বিএসএফ, রাজ্য পুলিশ, র‌্যাফ, রিজার্ভ ব্যাটেলিয়ন। শেষে কুকি ইনপি, আইটিএলএফ। প্রতি চেকিংয়ে অফিসের আইকার্ড, আধার কার্ড, কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাব, কেন যাব, কখন ফিরব, কোথায় ফিরব—তার সব বিবরণ দিতে হবে লিখিত। হবে গাড়ির খানাতল্লাশি।

এ বার জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বিমল আকোইজাম কংগ্রেসের প্রার্থী। তিনি বলছিলেন, ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর থেকে এমন ভয়াবহ মানবিক সঙ্কট দেশ দেখেনি।

কুকি যৌথ মঞ্চের নেতার আক্ষেপ, মনে হচ্ছে উগান্ডা, সোমালিয়া, আফগানিস্তানে বাস করছি। অথচ ১১ মাসে সমস্যা সমাধানের কোনও চেষ্টাই দেখছি না।

কোয়াকতায় কুকি-মেইতেই সীমানায় কমবয়সিরা কমান্ডো পোশাকে, হাতে অস্ত্র নিয়ে যৌথ বাহিনীর জওয়ানদের সামনে ঘুরছে। অসমিয়া এক নায়েব সুবেদার বলছিলেন, ‘‘উপরের অর্ডার পেলে এক দিনে আমরা সব ঠান্ডা করে দিতে পারি।’’ কিন্তু ওই যে! যুযুধান দুই পক্ষের নেতা ও জনতা উভয়ই অকপট— রাজনৈতিক কারণে জিইয়ে রাখা হচ্ছে এই লড়াই। তাঁদের অভিযোগ, ‘প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাকৃত অবজ্ঞাও নিশ্চিত কৌশলী চাল।’

চূড়াচাঁদপুরের নাম বদলে কুকিরা রেখেছেন লামকা। ঢোকার মুখে রাস্তার মাঝে গলায় দড়ি দিয়ে ঝোলানো মুখ্যমন্ত্রীর প্রতীক-পুতুল। কুকিভূমির ক্ষমতাশালী যৌথ মঞ্চ আইটিএলএফের সাধারণ সম্পাদক মুয়ান তোমবিংয়ের চেয়ারের পাশের দেওয়ালে চোখ টানে মিজ়োরামের মুখ্যমন্ত্রী লালডুহোমার ছবি। কারণ, তিনি স্থানচ্যুত ১২ হাজার কুকিকে আশ্রয় দিয়েছেন। তার উপরে সমর্থন জানিয়েছেন কুকি-জ়ো-চিনদের নিয়ে বৃহত্তর জ়োল্যান্ড গঠনের দাবিতে।

তুরবং-এ আসাম রাইফেলসের ২৭ নম্বর সেক্টরের সদর দফতরের মোড়েই রাস্তার পাশে রাখা প্রতীকী একশো কফিন। তার পিছনে ‘শহিদ-স্মারক দেওয়াল’। যেখানে একে একে জমেছে ১৫৭ জন নিহতের নাম, ছবি।

মুয়ান বলছিলেন, সংঘর্ষের পরে ট্রাক প্রতি ৮০ হাজার থেকে ১ লক্ষ টাকা খরচ হচ্ছে। মেইতেইরা আনতে দিচ্ছে না ওষুধ। আইএএস, আইপিএস ও অন্য কুকি আমলারা রাজধানী ছেড়ে কুকি এলাকায় যেখানে পেয়েছেন পোস্টিং নিয়েছেন। অনেকে মেনে নিয়েছেন অবনমন। সরকার বলেছে বাড়ি গড়তে ১০ লক্ষ টাকা দেবে। সেই টাকায় ইম্ফলে কুকিদের বিরাট বাড়ির বদলে বড়জোর গ্রামে এক তলা বাড়ি হবে। তাই ইম্ফলের সব জমি-বাড়ির বিবরণ-সহ পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ চেয়ে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হবেন কুকিরা।

তবে মুয়ান কেন্দ্রকে দোষ দিচ্ছেন না সচেতন ভাবেই। বলছেন, “সব দোষ রাজ্যের বিজেপি সরকারের। তাই ভোট বয়কট করছি না। নাগা প্রার্থীদের এখানে প্রচার চালাতেও বাধা দিচ্ছি না।” নির্বাচন কমিশন নির্দেশ দিলেও কুকি এলাকা থেকে অবশ্য জানানো হয়েছে, তারা অস্ত্র জমা দেবে না।

আইটিএলএফ প্রতিরক্ষা বাহিনীর নেতা লেলেন হাওকিপ বাঙ্কারে দাঁড়িয়ে বলেন, “কমিশনের বিরোধী নই, সংবিধানের বিরোধীও নই। কিন্তু আমাদের মাটি, আমাদের প্রাণরক্ষার ভার এখন আমাদেরই হাতে। নিরস্ত্র মৃত্যু বরণ করতে পারব না।”

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে
Captcha verification failed!
CAPTCHA user score failed. Please contact us!

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য

error: <b>Alert: </b>Content selection is disabled!!