Friday, March 29, 2024
বাড়িবিশ্ব সংবাদইউক্রেইনের ভাগ্য, ওলেগ থেকে জেলেনস্কি

ইউক্রেইনের ভাগ্য, ওলেগ থেকে জেলেনস্কি

স্যন্দন ডিজিটাল ডেস্ক, আগরতলা,১৩ অক্টোবর: বিপুল উর্বর সমভূমির জন্য এই দেশ প্রাচীনকাল থেকেই আগ্রাসীদের কাছে আকর্ষণের শীর্ষে। এখানকার কলিজার মতো মাটিতে সহজেই উৎপাদন করা যায় বিপুল মাছ, মাংস, খাদ্যশস্য। ইউক্রেইনের আদি অধিবাসীরা খ্রি.পূ. ৫০০০ থেকে ৩০০০ অব্দের মধ্যে ভূমধ্যসাগর ও মধ্য এশিয়া থেকে এখানে এসে বসতি শুরু করে। খ্রি.পূ. ৭০০-৫০০ অব্দের দিকে গ্রিকরা এখানে উপনিবেশ স্থাপন করে। খ্রি.পূ. ২০০ অব্দের দিকে গথরা আসে বাল্টিক এলাকা থেকে। তারপর কালে কালে দিকে দিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির উত্থান হলে ইউক্রেইন অনেকের শাসনে আসে। সেই সাম্রাজ্যবাদীদের মধ্যে রয়েছে বাইজান্টাইন, টার্কিশ, হুন প্রভৃতি। আর এ যুগে একদিকে ইউরোপ-আমেরিকা আরেকদিকে চীন-রাশিয়া বলয়। ইউক্রেইনের রাজনীতিকরা কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পারেননি হাজার বছরেও।খ্রিস্টিয় মধ্যনবম শতাব্দীতে ভাইকিং সমরনায়ক ওলেগ ‘কিয়েভান রুশ’ নামে একটি রাষ্ট্র গঠন করেন। কিয়েভ ছিল তার রাজধানী। সেই দেশটি কালে কালে তাদের ভূসীমানা নির্ধারণ করে ইউক্রেইন নাম নিয়েছে। আর তার রাজধানী আজও রয়েছে কিয়েভ।ওলেগের নজর ছিল বহুদিকে। তিনি তার সামরিক সক্ষমতা যেমন বাড়ান তেমনি বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির দিকেও নজর দেন। ‘সভ্য’ বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য তাকে অনুপ্রাণিত করে থাকবে।

 বাইজান্টাইনের সাথে তিনি বাণিজ্যিক চুক্তি করেন ৯১১ খ্রি.। গ্রিসের সোনা, কাপড়, সুস্বাদু ফলমূল, মদ; চেকোস্লাভাকিয়া ও হাঙ্গেরির ঘোড়া, সিলভার; উত্তরের ঘন জঙ্গলের বসবাসকারী রুশদের মোম, মধু, পশম ও দাস পরস্পরের মধ্যে বিনিময় করেন ওলেগ। দিনিপ্র নদ ছিল কিয়েভানদের প্রধান ও একমাত্র অবলম্বন। এই নদ তাদের সংযুক্ত করেছে কৃষ্ণ সাগরের মধ্য দিয়ে ভূমধ্যসাগরের সাথে। এই সময় রুশ শব্দটা তৎকালীন কৃষ্ণ সাগর ও ভূমধ্যসাগর এলাকায় পরিচিত হয়ে ওঠে এবং কিয়েভান রুশ দেশের মানুষও রুশ হিসেবে পরিচিত লাভ করে।ওলেগ ৯১২ খ্রি. মারা গেলে তার উত্তরসূরি হন ভ্লাদিমির।ভ্লাদিমির অন্য ভাইদের হত্যা করে ৯৮০ খ্রি. নিজেকে ‘প্রিন্স অব রুশ’ ঘোষণা করেন। ৯৮৮ খ্রি. ভ্লাদিমির এক যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়ে দেন পূর্ব ইউরোপে। তিনি রাষ্ট্রধর্ম চালুর চিন্তা করেন। তার ধর্ম কমিটি দুটি ধর্মকে প্রাধান্য দিয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে বলে মনে করেন অনেকে। একটা ইসলাম আর অন্যটা হল খ্রিস্ট। শ্রুতি আছে, ভ্লাদিমির ইসলাম গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন বহু স্ত্রী গ্রহণের সুযোগ থাকায়, কিন্তু সেখানে মদ নিষিদ্ধ হওয়ায় তিনি খ্রিস্টধর্ম গ্রহণ করেন। এই ধর্ম কিয়েভানদের মধ্যে অল্প সময়ে ব্যাপক প্রভাব ফেলে। খ্রিস্টধর্ম শক্তিশালী হয়ে ওঠে ইতোমধ্যেই প্রভাব সৃষ্টিকারী ইসলাম ধর্মের মতো।১০১৫ খ্রি. ভ্লাদিমির মারা গেলে তার ছেলে ইয়েরোস্লাভ দ্য ওয়াইজ বা ইয়ারোস্লাভ ১ ভ্লাদিমিরোভিচ (খ্রি. ৯৭৮-১০৫৪) তার অন্য চার ভাইকে হত্যা করে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি উত্তরাধিকার আইনসহ লিগ্যাল কোড প্রণয়ন করেন।

একাদশ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি নাগাদ এখানে মেট্রপলিটন অব কিয়েভ, চার্চ হায়ারার্কি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যপ্রাচ্যের খ্রিস্টান ধর্ম এখানে নিয়ে আসে মধ্যপ্রাচ্যের স্থাপত্যরীতি, লিখিত ভাষা, সাহিত্য, সংগীত প্রভৃতি। কিন্তু তখন ইউক্রেইনের অধিবাসীরা কোনো জাতীয় চেতনায় সমৃদ্ধ হতে পারেনি মঙ্গল, তাতার, টার্কিশ, পোলিশ প্রভৃতি এবং সর্বশেষ রাশিয়ানদের আগ্রসনের কারণে। এসব আগ্রাসনের মধ্য দিয়ে এখানে আসে বিপুল সংখ্যক পোল, জার্মান, আর্মেনিয়ান, ইহুদি, রাশিয়ান প্রভৃতি। তাদের মাধ্যমে, অষ্টাদশ খ্রি. পর্যন্ত, ইউক্রেইনে গড়ে ওঠে এক মিশ্র সংস্কৃতি। রুশরা ইউক্রেইনের ওপর সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়। কৃষ্ণ সাগর ও আজব সাগরের মাধ্যমে রাশিয়ানদের সাথে ইউক্রেইনের মানুষ সহজেই বাণিজ্যিক সংযোগ স্থাপন করতে পারত, যা কঠিন ছিল হাঙ্গেরি, অস্ট্রিয়া, পোল্যান্ড প্রভৃতি দেশের সাথে। উপরিউক্ত কারণে জাতীয়তাবোধ সৃষ্টিতে সময় লাগে বহু বছর। ১৮৬০-এর দিকে প্রথম ইউক্রেনিয়ান ন্যাশনাল মুভমেন্ট গড়ে ওঠে। ১৯১৮ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষ এবং রাশিয়ান সম্রাটের পতন হলে ইউক্রেইন স্বাধীনতা ঘোষণা করে। একই সময় রাশিয়ায় প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইউনিয়ন অব সোভিয়েট সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক’ (ইউএসএসআর)। ১৯২১ সালে ইউক্রেইনে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘ইউক্রেনিয়ান সোভিয়েত সোশ্যালিস্ট রিপাবলিক’ (ইউক্রেইন এসএসআর) এবং তারা ইউএসএসআরের অন্তর্ভুক্ত হয়। এ সময় ইউক্রেইনে রুশ প্রভাব আরও বাড়ে। এর ৭০ বছর পর, ১৯৯১ সালে, ইউএসএসআর ভেঙে গেলে ইউক্রেইন একটি স্বতন্ত্র দেশ হিসেবে আর্বিভূত হয় পৃথিবীর ইতিহাসে। তখন অনেকেই মনে করেছিলেন এবার আধুনিক সভ্যতার যুগে ইউক্রেইন নিজের মতো মাথা তুলে দাঁড়াবে। কিন্তু অল্প সময়েই তাদের আকাশে মেঘ ঘনিয়ে আসে।তাদের নেতৃত্বের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখানে ঘাঁটি গাড়তে চায়। সেটা সম্ভব হলে তা হবে তার চিরশত্রু রাশিয়ার ঘরের ভেতর ঘোগের বাসা বাঁধার মতো। সুতরাং রাশিয়াও ইউক্রেইনে তাদের প্রভাব নিশ্চিত রাখতে চায়।

এই দ্বিপক্ষীয় প্রভাব আড়াই দশকের টানাপোড়েন শেষে ২০১৪ সালে রীতিমতো যুদ্ধে রূপ নেয়। ঘটনার চূড়ান্ত শুরু ২০১৩ সালের নভেম্বরে ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট ইয়ানুকোভিচ যখন ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের (ইউ) সাথে সহযোগিতা চুক্তি সই করতে গিয়ে হঠাৎ থেমে গেলেন। এর প্রতিবাদে হাজার হাজার ইইউ-পন্থী নাগরিক রাজধানী কিয়েভসহ বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভ করে। তাদের অভিযোগ, ইয়ানুকোভিচ রাশিয়ার পক্ষে কাজ করেন। ওই বছর ফেব্রুয়ারিতে আন্দোলন জোরদার হলে পুলিশ হত্যা করে কমপক্ষে ৭৭ জন নাগরিককে। ফলে আন্দোলন আরও জোরদার হয়। পার্লামেন্টে ইয়ানুকোভিচের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পাশ হয়।ইইউ-পন্থীদের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন প্রধানত পেটরো পোরোশেংকো। তিনি একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিক। তার ‘৫ ক্যানাল’ টিভি চ্যানেল ওই সময় ছিল ইউক্রেইনের সবচেয়ে জনপ্রিয় মিডিয়া, যা আন্দোলন সংগঠন এবং জোরদার করতে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে একচেটিয়া ভূমিকা পালন করে। আন্দোলনের মুখে ওই ফেব্রুয়ারিতে ইয়ানুকোভিচ পালিয়ে যান রাশিয়ায়। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিন প্রথম থেকেই ওই আন্দোলনের বিরুদ্ধে এবং ইয়ানুকোভিচের পক্ষে কথা বলে আসছিলেন। ওই বছর জুনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে পেটরো পোরোশেংকো হন ইউক্রেইনের প্রেসিডেন্ট। শান্ত হয় ইইউ-পন্থী আন্দোলনকারীরা। কিন্তু ক্ষুব্ধ হন ইউক্রেইনে বসবাসরত রুশ নাগরিক ও রুশপন্থী ইউক্রেনিয়ানরা। তারা ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেন এবং রুশ হস্তক্ষেপ আশা করেন। ক্রিমিয়া প্রণালীতে সৈন্য সমাবেশ ঘটায় রাশিয়া। ইউক্রেইনের পূর্বাঞ্চলীয় স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ ক্রিমিয়া। এর নেতারা রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে যোগাযোগ করেন বলে অভিযোগ করে ইউক্রেইন ও ইইউ; তাদের সাথে সুর মেলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। তাছাড়া ক্রিমিয়ার মুখ্যমন্ত্রী সের্গে অ্যাকসিওনোভ মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার আগে থেকেই প্রায় দুই দশক ধরে ক্রিমিয়াকে রাশিয়ার সাথে যুক্ত করার প্রচারণা চালিয়ে আসছেন এবং জনমত সৃষ্টিতে তিনি সফল বলা চলে। কিন্তু ইইউ বা ইউএসএ তা বরদাশত করে না।অস্ত্রশস্ত্রসহ রুশ সৈন্যদের সাথে পেয়ে বিদ্রোহ জোরদার করে রুশপন্থী ইউক্রেনিয়ানরা। ইউক্রেইনের সেনাবাহিনী নাস্তানাবুদ হয় ক্রিমিয়ার বিদ্রোহীদের কাছে। কিন্তু ইইউ এবং ইউএসএর অবরোধ-নিষেধাজ্ঞার হুমকিতে সৈন্য সরিয়ে নেয় রাশিয়া, তবে সেটা আপাতত আত্মরক্ষা বলেই ধারণা করা হয় ওই সময়। পরে ২০১৪ সালেই গণভোটের মাধ্যম্যে ক্রিমিয়া রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়। পশ্চিমা দেশগুলো এখনও ক্রিমিয়াকে আনুষ্ঠানিকভাবে রুশ ভূখণ্ড হিসেবে স্বীকৃতি দেয়নি বটে। তা না দিলেইবা কী। অস্ত্রের ক্ষমতাই শেষ ক্ষমতা। তাই পশ্চিমাদের অসংখ্য নিষেধাজ্ঞায়ও গা করছেন না পুতিন। এই নিষেধাজ্ঞা এবং ইউক্রেইন যুদ্ধ ডজনখানেক দেশের দেউলিয়া হওয়ার পথে চূড়ান্ত ধাক্কা যদিও। নিষেধাজ্ঞার কারণে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের লেনদেন-ব্যবস্থা যথেষ্ট গুলিয়ে যাওয়ায় এই দেউলিয়াত্ব।

ইউক্রেইনের অর্থনীতি

কৃষিজ উৎপাদনে ইউরোপের অন্য দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে এই দেশ। প্রধান ফসল আলু। ইউরোপের অন্য যেকোনো দেশের চেয়ে বেশি আলু উৎপাদন করে দেশটি। তাছাড়া সুগার বিট (মুলাজাতীয় ফসল, যা থেকে চিনি উৎপন্ন হয়) ও সূর্যমুখী তেল উৎপাদনে তার অবস্থান সারা পৃথিবীতে প্রথম স্থানে। অন্য ফসলের মধ্যে রয়েছে বার্লি, ভুট্টা, গম, ধান, সরিষা, মরিচ প্রভৃতি।কৃষ্ণ সাগর ও আজব সাগর দেশটির প্রধান মৎসভাণ্ডার। নদ-নদীতেও মাছ পাওয়া যায়।সারাদেশেই গরু, ছাগল, ভেড়া, শূকর, হাঁস-মুরগি ও অন্যান্য পশুপাখি পালন করে ডিম-দুধ-মাংসের চাহিদা মেটায় তারা।খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ ইউক্রেইন। প্রচুর পরিমাণে লৌহ আকরিকসহ এখানে রয়েছে গ্যাস, ম্যাঙ্গানিজ, কয়লা প্রভৃতি। কেমিক্যাল ও মেটালসহ সব ধরনের হালকা কারখানা রয়েছে ইউক্রেইনে। ভারী কারখানা হিসেবে এর আয়রন ইন্ডাস্ট্রি সারা পৃথিবীতে প্রথম শ্রেণির। আয়তনের দিক দিয়ে ইউরোপের বড় পাঁচ দেশ: রাশিয়া ১৭,০৯৮,২৪৬ বর্গ কিলোমিটার, ইউক্রেইন ৬০৩,৫০০ বর্গ কিলোমিটার, ফ্রান্স ৫৪৩,৯৪০ বর্গ কিলোমিটার, স্পেন ৫০৫,৯৯২ বর্গ কিলোমিটার, সুইডেন ৪৫০,২৯৫ বর্গ কিলোমিটার।

সম্পরকিত প্রবন্ধ

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে

সবচেয়ে জনপ্রিয়

সাম্প্রতিক মন্তব্য